শীত ও বাতাস উপেক্ষা করে গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তালা উপজেলার চাষিরা। একদিকে আখ কেটে সংগ্রহ করা হচ্ছে, অন্যদিকে কেটে আনা আখ থেকে মেশিনের মাধ্যমে রস সংগ্রহ করে সেই রস জাল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গুড়। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, তালা উপজেলার এ বছর আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ৫৫ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লাভবান হবেন আখ চাষিরা। তালার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, শীত বাড়তেই বাঙালির ঘরে রসের খিরসহ পিঠা-পুলির মহোৎসব। গ্রামের নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরীরা আখ থেকে পাতা ও আগা বাদ দিয়ে আলাদা করে রাখছেন। সেই পাতা ও আগার অংশটুকু নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে গৃহপালিত পশুর খাবার হিসেবে। এরপর রেখে দেওয়া আখ থেকে কারিগররা একটি মেশিনের মাধ্যমে রস বের করছে। তাতেই আখের রস ঢেলে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। সেই কড়াইয়ের দিকে সজাগ নজর কারিগরদের। পরে তা চুলা থেকে নামিয়ে ২০ থেকে ২৫ মিনিট রাখার পর শক্ত হয়। পরে কারিগরদের হাতের সাহায্যে শক্ত গুড়গুলোকে একটি নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি করা হয় আখের রস থেকে সুস্বাদু গুড়। আখ মাড়াই কাজে নিয়োজিত বিপ্লব, আনারুল, গনেশসহ কয়েকজন জানান, আখের রস জ্বাল দেওয়ার পর তা ঘন হয়ে উঠলে টিনের তৈরি ড্রামের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। উত্তাপ কমে এলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে গুড় জমাট বাঁধে। এ ছাড়া আখের রশিও (তরল গুড়) বাজারে বিক্রি হয়। তরল গুড় আলাদা বোতলে সংরক্ষণ করা হয় বাজারজাতের উদ্দেশ্যে। আখের মান ভালো হলে প্রতি খোলা (গুড় জ্বাল দেওয়ার কড়াই) থেকে ৪০-৫০ কেজির মতো গুড় পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার-পাঁচটি গুড়ের খোলা ওঠানো সম্ভব হয়। স্থানীয় আখচাষিরা বলেন, এখানকার গুড় নির্ভেজাল ও খাঁটি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। চাষে খরচ কম ও তুলনামূলক লাভজনক হওয়ায় আগ্রহ বাড়ছে স্থানীয় কৃষকদের। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর আখের ফলনও ভালো হয়েছে। তবে কৃষি অফিসের সহযোগিতা পেলে উপজেলায় আখ ও গুড়ের উৎপাদন বাড়বে। আখের গুড় তৈরির কারিগর চরগ্রামের মো. কবির আলী বলেন, শীত মৌসুমের শুরু থেকেই আমরা মহাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেলা-উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আখের রস থেকে গুড় বানানোর কাজ করি। আখ কাটা থেকে শুরু করে গুড় তৈরি পর্যন্ত প্রায় এক মাস এখানে থাকতে হয়। এরপর আবার অন্য এলাকায় গুড় তৈরির জন্য যাবো। এভাবেই শীতের সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৩-৫কড়াই গুড় তৈরি করি। পারিশ্রমিক হিসেবে কড়াই প্রতি ৯০০শত থেকে ১২শত টাকা করে পাই। এতে করে কোনো রকম ডাল-ভাত খেতে পারি। আখচাষি আমজাদ আলী বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে আখ চাষে খরচ হয় মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে প্রতি বিঘা জমি থেকে উৎপাদিত আখের গুড় বিক্রি করে লাভ হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি আখের গুড় পাইকারি ১৩০ থেকে ১৫০টাকা কেজি। খুচরা বিক্রি করা যায় ১৬০ থেকে ১৮০টাকা কেজি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় গুড় সরবরাহ করা হয়। সরকারি প্রণোদনা পেলে আখের গুড় উৎপাদন বাড়াতে পারবেন বলে আশা করেন প্রান্তিক কৃষকরা। আখ ক্ষেতের মালিক আকবর মোল্লা বলেন, এক মৌসুমের ফসল চাষ করার পর আখ চাষ করি। বিগত বছরগুলো আমাদের জন্য অনেক ভালো ছিল। আশা করছি এ মৌসুমে গুড় ও পাটালী বিক্রি করে ভালো পরিমাণে লাভবান হব। তালা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাজেরা খাতুন বলেন, চলতি মৌসুমে তালা উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আখের চাষ হয়েছে। আখচাষিদের জন্য তেমন সরকারি কোনো প্রকার বরাদ্দ না থাকায় আমরা তাদের শুধু পরামর্শ দিয়ে থাকি।