সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:০৮ অপরাহ্ন

তারকা জেমসকে পায়নি আজিজ বোর্ডিং, পায়নি মা-বাবাও

প্রতিবেদকের নামঃ
  • প্রকাশের সময়ঃ বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০২৪
  • ২০ প্রদর্শন করেছেন

গানের সুরে জীবনটা বাঁধতে আশির দশকের শুরুর দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন জেমস। আজও দেশ-বিদেশে ছুটছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটা দেশ এ বছর মাতিয়েছেন। তাঁর একটা গানের কথা এ রকম, ‘চোরা সুরের টানে রে বন্ধু,/ মনে যদি ওঠে গান,/ গানে গানে রেখো মনে/ ভুলে যেয়ো অভিমান…।’  ফলে ‘আপনি কেন নিজেকে আড়ালে রাখেন?’ এই প্রশ্ন করতে গেলেও অভিমানটা গিলে ফেলতে হয়। নিজের চরিত্রের এই দিকটা নিয়ে জেমস প্রথম আলোর এই প্রতিবেদককে ব্যাখাটা দিয়েছিলেন এ রকম, ‘একা থাকতে পছন্দ করি। তখন হয়তো নিজের মতো ভাবি, ভাবতে ভালো লাগে। চুপচাপ থাকলে কোনো একটা বিষয় নিয়ে ফোকাসড থাকা যায়। তবে আমি তো গানের জন্য সব সময়ই অ্যাভেইলেবল। দেশে এবং দেশের বাইরে স্টেজ শো করছি নিয়মিত। আমি নিজের মতো করে কাজ করতে পছন্দ করি। বাড়তি আড্ডা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না।’

জেমসের ছেলেবেলা কেমন কেটেছে, তা নিয়ে সবার প্রবল আগ্রহ। তাই প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি তো গানে গানে বলেছেন, “মোরা শাসন মানি না, বারণ শুনি না, করি টালবাহানা, করি নানা ছলনা…।” আসলেই কি তেমনটা ছিলেন?’ জেমস স্মৃতিকাতর হয়েছিলেন কি না, বোঝা গেল না, প্রশ্ন শুনে কেবল বলে গেলেন, ‘ছোটবেলা থেকে সাঁতারে ভীষণ ঝোঁক ছিল। বেশ ভালো সাঁতরাতেও পারতাম। দুরন্ত আমি বন্ধুদের নিয়ে আশপাশের পুকুরে সাঁতার কাটতাম। নওগাঁয় থাকতে ১০-১২ বছর বয়সে সাঁতার কাটতে চলে যেতাম নদীতে। বেশ কয়েকবার তো সাঁতরে মাঝনদীতেও চলে গিয়েছিলাম! এখন তো আর নদীতে সাঁতার কাটার সুযোগ নাই…।’

জেমসের নদীর কাছে যেতে না পারার কষ্ট কতটা প্রবল, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। তবে নদীর প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর অনেক গানেই। যেমন ‘দুখিনী দুঃখ করো না’ অ্যালবামে ছিল ‘তুমি যদি নদী হও, আমি হব জেগে থাকা চর…’ গানটি।

জেমসের বাবা মোজাম্মেল হক ছিলেন সরকারি চাকুরে। সেই সূত্রে তাঁর প্রথম স্কুল ছিল সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুল। তারপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। আর নীলফামারী ও সিরাজগঞ্জের কলেজজীবনে কেটেছে দারুণ কিছু সময়। কলেজজীবনের পর জেমসের মাথায় ঢোকে গানের পোকা। পরিবারের কেউ কখনো গানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে বড় ছেলে জেমসের গায়ক জীবন চাননি বাবা মোজাম্মেল হক ও মা জাহানারা খাতুন। আর তাই অভিমানী জেমসকে ঘর ছেড়ে পথে নামতে হয়। তাঁর গানের কথায়, ‘পথের বাপই বাপ রে মনা, পথের মা-ই মা…।’ সেই পথ চলতে চলতে তাঁর ঠিকানা হয়ে যায় চট্টগ্রামের কদমতলীর পাঠানটুলি রোডে মতিয়ার পুলের সেই আজিজ বোর্ডিংয়ের ৩৬ নম্বর কক্ষটি।

জেমস বলছিলেন, ‘আড্ডা আর গান যা-ই হোক না কেন, সব ওখানেই। আজিজ বোর্ডিংয়ের দিনগুলো কখনো ভুলব না।’এই কথাগুলোই জেমস বলেছেন ‘আজিজ বোর্ডিং’গানটিতেও, ‘কত স্বপ্নের পায়রা ছুঁয়ে গেছে মন,/ শত স্মৃতির কিংখাবে,/ বন্দী সে দিন এখন।/ প্রিয় আজিজ বোর্ডিং, প্রিয় আজিজ বোর্ডিং…।’

আজিজ বোর্ডিংয়ে গানের কথা আর সুরের নেশায় ঘুমহীন অনেক রাত কেটেছে জেমসের। সেখানে ছিল তাঁর ‘ছোট্ট একটি ঘর, ছোট্ট একটি খাট,/ছোট্ট একটি টেবিল, একটি পানির জগ।/ছিল একচিলতে আকাশ আমার,/ আর সেই প্রিয় গিটার।’ তারকা হয়ে ওঠার পর অবশ্য আর কখনোই সেখানে যাওয়া হয়নি তাঁর। তবে যে কক্ষে থাকতেন, সেখানে এখনকার বাসিন্দারা ‘গুরু’র জন্মদিনে কেক কাটে প্রতিবছর। ‘আবারও কি সেখানে যেতে চান?’ জেমসের উত্তর, ‘কখনো সময়-সুযোগ হলে ঢুঁ মারলেও মারতে পারি।’

তারকা জেমসকে আজিজ বোর্ডিং কখনো পায়নি। পায়নি তাঁর মা-বাবাও। গানের জগতে জেমসের সাফল্যের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আগেই দুজনই চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। জেমস তাঁর গাওয়া ‘মা’ গানে বলেছেন, ‘সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখো, পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে…।’

জেমসের ৬০ তম জন্মদিন আজ। ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর নওগাঁয় তাঁর জন্ম।  জেমসের ছোট ভাই রুশো এখন নওগাঁতেই থাকেন। দেখাশোনা করেন পারিবারিক ব্যবসা। আর এখনকার পরিবার? আপনার সন্তানদের সম্পর্কে আমরা জানিই না বলা চলে। জেমস এ কথা শুনে স্বভাবসুলভ মাপা হাসি হেসে বললেন, ‘আমার গানের জীবনের বাইরে ব্যক্তিজীবনটা প্রকাশিত হোক, সেটা কখনো চাইনি। এ কারণেই হয়তো আমার পারিবারিক জীবনটা সেভাবে খুব কাছের কেউ ছাড়া সবার জানার সুযোগ হয়নি। এটা আমি শুরু থেকেই করে এসেছি। আমার তিন সন্তান—সবার বড় ছেলে দানেশ, তারপর মেয়ে জান্নাত ও জাহান।’জেমসের পরিবারের অগ্রজদের কেউ যেমন গানের জগতে নেই, অনুজদের মধ্যেও কেউ গানের সুরে জীবন বাঁধেনি।

কথায় কথায় জেমসের অবসরজীবনের প্রসঙ্গও আসে। এ প্রসঙ্গ তুলে ধরতেই জেমস বললেন, ‘সবাই যে রকম করে, আমারও তেমন। টেলিভিশন দেখি। বই পড়ি। ছবি তোলার একটা নেশা আছে, যখন সময় পাই ছবি তুলি। এভাবেই কেটে যাচ্ছে।’ সিনেমার মধ্যে ক্ল্যাসিকগুলো বেশি দেখেন জেমস। জেমসের প্রিয় লেখক অনেকেই। তাঁদের মধ্যে সবার আগে আছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নাম।

ফেসবুকে জেমসের ফলোয়ারমাত্রই জানেন, আলোকচিত্রী হিসেবেও তিনি কম যান না। কয়েক বছর ধরে ছবি তুলে মাঝেমধ্যে ফেসবুকে পোস্ট করছেন। এই প্রতিভা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন? জেমসের মুখে হাসি, ‘ভিনদেশে শো করতে গেলে কিছু অবসর সময় থাকে। তখন সেটা কাজে লাগানোর জন্যই ছবি তোলা।

ফটোগ্রাফারমাত্রই জানে, এটা অদ্ভুত একটা নেশা। একবার ফটোগ্রাফির পোকা ঢুকলে মাথা থেকে বের করা মুশকিল। ল্যান্ডস্কেপ আমাকে বেশি টানে। আবার যখন একটু অলস হয়ে গেলাম, তখন মডেলদের ছবি তুলতে শুরু করলাম। কারণ, এটা বাসায় বসে বসে করা যায়। লাইট-টাইট নিয়ে নাড়াচাড়া করা। লাইটের ভাষা শেখা আরকি।’

কক্সবাজারের কিছু ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি করেছেন জেমস। কিন্তু দেশে একটাই সমস্যা, ল্যান্ডস্কেপ তুলতে গেলেই ভক্তরা ভিড় করেন। খ্যাতির বিড়ম্বনা যাকে বলে, ‘ফটোগ্রাফি এমন একটা বিষয় আপনাকে অবশ্যই ইনভিজিবল থাকতে হবে। আমি ছবি তুলতে গেলে বাংলাদেশে মানুষ জড়ো হয়ে যায়। তখন আর ছবি তোলা হয় না। ফটোগ্রাফার থাকবে একদম সবার অন্তরালে। তবে পিরোজপুরের নৌকায় ভাসমান পেয়ারার হাটের ছবি তুলতে চাই। এটা কীভাবে যে হবে, তা নিয়ে ভাবছি। আর আমার তোলা এই ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনী হলেও হতে পারে,’ বলেন জেমস।

শখের কথা গেল, বন্ধুদের কথা কিছু শোনা যাক। জেমসের বন্ধু কারা? আপনি তো গানে গানে বলেছেন ‘তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে বন্ধু আমার?’জেমস জানালেন, স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। সবাই আসলে ব্যস্ত থাকে তো, তাই আগের মতো আর যোগাযোগ হয়ে ওঠে না।’ গানের জগতেও বেশ কয়জন ভালো বন্ধু পেয়েছিলেন জেমস। তাঁদের মধ্যে হামিন আহমেদ, মাকসুদ ও পার্থ বড়ুয়া উল্লেখযোগ্য। প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুও ছিলেন জেমসের খুব ভালো বন্ধু। তাঁরা কেন ভালো বন্ধু এর উত্তরটা দিয়েছিলেন এভাবে, ‘আলাদাভাবে বলাটা মুশকিল। এটা বলতে পারি, আমাদের সবার শুরুটা হয়েছিল একসঙ্গেই। অনেক চড়াই-উতরাই ও ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী আমরা। সংগীতজীবনের শুরুতে অনেক দিন-রাত আমরা একসঙ্গে থেকেছি। প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছি। আবার একসঙ্গে সব পরিকল্পনা করেছি। এখনো বামবা নিয়ে যখন কোনো আলোচনা হয়, আমরা এক হই। আড্ডা দিই।’

গান আর জীবন নিয়ে কিছু শুনতে চাই জেমসের কাছে। জেমস তা জানালেন এভাবে, ‘প্রতিটা দিনই আমি আমার মতো করে উপভোগ করি।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ