রাজশাহীতে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ইটভাটা। এসব ইটভাটার অধিকাংশই অবৈধ। অধিকাংশের নেই লাইসেন্স। নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। রাজশাহীতে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ফসলের মাঠ উজাড় করে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। উর্বর জমির টপ সয়েল কেটে অবাধে এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে ইট। প্রশাসন ও পরিবেশ দপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে এসব অবৈধ ইটভাটা। আবার যেগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে, সেগুলোয় মানা হয় না কোনো পরিবেশ আইন ও নির্দেশনা। রাজশাহীতে পরিবেশদূষণে এসব ইটভাটার ভূমিকাই বড়। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি মাসের শেষে রাজশাহীর অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে লাগাতার অভিযান শুরু করা হবে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী জেলার বিভিন্ন এলাকায় কাগজে-কলমে ইটভাটা রয়েছে ১৩৬টি। তবে কাগজে-কলমে ছাড়া আরও শতাধিক ইটভাটা রয়েছে রাজশাহী জেলাজুড়ে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী রাজশাহীর তালিকাভুক্ত ১৩৬টি ইটভাটার মধ্যে মাত্র ৩০টির লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। বাকিগুলোর কোনো ছাড়পত্র নেই।
জানা যায়, অবৈধ এসব ইটভাটা বছরের পর বছর চলছে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। জানা যায়, রাজশাহী জেলায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে গোদাগাড়ী ও নগরীসংলগ্ন পবা উপজেলায়। পবায় এককভাবে রয়েছে ৫০টির বেশি ইটভাটা। এসব ইটভাটার প্রায় সবই ফসলি মাঠ ও আমবাগান।
গোদাগাড়ীর বসন্তপুর, কাদিপুর, গোপালপুরসহ কয়েকটি এলাকার একাধিক ইটভাটা ঘুরে দেখা যায়, মাঝেমধ্যে বসানো রয়েছে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপ। ইটভাটা গড়ে উঠেছে সেচ প্রকল্পের আওতাধীন ফসলি জমিতেও। ইট তৈরির জন্য বরেন্দ্র ভূমির উঁচুনিচু টিলা কেটে লাল মাটি দিয়ে ইট তৈরি করে পোড়ানো হচ্ছে। ভাটায় মাটি আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে শত শত ট্রলি ও ট্রাক্টর। এসব ট্রাক্টর থেকে মাটি ঝরে পড়ে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কের এখন একাকার অবস্থা। নির্মাণের দুই বছরের মাথায় ব্যস্ত এ সড়কটির বিভিন্ন স্থান ভেঙে গেছে। এতে যান চলাচলে বেড়েছে ঝুঁকি। অন্যদিকে মাটি ও ইটবাহী ট্রাক্টর ট্রলির ধাক্কায় ঘটা দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু রাজশাহীতে কোথাও এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। তিন ফসলি উর্বর জমির টপ সয়েল কেটে প্রশাসনের নাগের ডগায় অবাধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। গ্রামীণ সড়কগুলো দিয়ে পরিবহণ করা হচ্ছে মাটি ও ইট। এতে শুধু ফসলি জমিই নষ্ট হচ্ছে তা নয়, এলাকাগুলোর রাস্তাঘাট, পরিবেশসহ ধ্বংস হচ্ছে প্রাণিকুলও।
নাম না প্রকাশের শর্তে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর একজন ভাটামালিক বলেন, রাজশাহীতে ইটভাটা চালাতে অনেক খরচ গুণতে হয়। বছর বছর লাইসেন্স নবায়নের জন্য জেলা প্রশাসনের ফান্ডে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। পরিবেশ ছাড়পত্র যাদের আছে, তাদেরকে বছর বছর পরিবেশের ছাড়পত্র নবায়নে টাকা দিতে হয়। আবার যাদের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই, তাদের আরও বেশি টাকা দিয়েই ম্যানেজ করতে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিএসটিআই-এর কর্মকর্তাদের। বিভিন্ন স্থানে ইট পরিবহণে পথে পথে চাঁদা দিতে হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, আইনে আছে ফসলি জমিতে কোনোভাবেই ইটখোলা তৈরি করা যাবে না। তবে রাজশাহীতে অধিকাংশ ইটভাটা তৈরি হয়েছে দুই বা তিন ফসলি জমিতে। অনাবাদি ও পরিত্যক্ত জমিতে ইটভাটা করা গেলেও দেখতে হবে এতে পার্শ্ববর্তী ফসলের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না। আমরা জেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে একাধিকবার অনুরোধ করেছি এসব ইটভাটা বন্ধ করার জন্য।
রাজশাহী জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক কবির হোসেন বলেন, রাজশাহীতে যেসব ইটভাটা রয়েছে, তার মধ্যে ২৫ থেকে ৩০টির পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। পরিবেশ শর্ত পালনে ব্যর্থ অধিকাংশ ইটভাটা বন্ধ করা হবে।
রাজশাহী ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি সাদরুল ইসলাম বলেন, আইনি নানা জটিলতার কারণে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাচ্ছেন না তারা। এ প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। আমরা প্রশাসন ও পরিবেশ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করছি। এখন হঠাৎ করে ভাটা বন্ধ করা হলে মালিকদের বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা বৈধভাবেই ব্যবসা করতে চাই।