সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৮ অপরাহ্ন

শেখ জামাল-শেখ রাসেল সেতুর টোলের সিংহভাগ লোপাট, টাকা ভাগাভাগি হতো বিকাশে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৬ প্রদর্শন করেছেন

সরকার পতন আন্দোলন দেখিয়ে গত ৫ আগস্ট দুপুর থেকে ৬ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শেখ রাসেল সেতু থেকে ৫০০ টাকা টোল আদায় দেখায় পটুয়াখালী সওজ বিভাগ। অথচ একই দিন পার্শ্ববর্তী শেখ কামাল সেতু থেকে অন্তত ৩৪ হাজার টাকা টোল আদায় করেন ইজারাদার। নির্ধারিত হারে ৫ আগস্ট শেখ রাসেল সেতু থেকে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা আদায়ের কথা। পূর্বের ইজারাদারের মেয়াদ শেষ হলে পটুয়াখালী সওজ কর্তৃপক্ষ বিভাগীয়ভাবে নিজস্ব জনবলে টোল আদায় করে ৫০ শতাংশ অর্থ হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর সওজ বিভাগীয়ভাবে শেখ কামাল সেতুর টোল আদায় করে। সওজের নিজস্ব ঠিকাদারের পরিকল্পিত মামলায় শেখ কামাল সেতুর টোল ইজারা টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ করে বিভাগীয়ভাবে টোল আদায় করে সওজ।

সূত্রমতে, টানা এক বছর শেখ কামাল সেতু থেকে প্রায় চার কোটি টাকা আদায় হলেও ৫০ শতাংশ অর্থ রাজস্ব খাতে জমা হয়। শেখ কামাল সেতুর এ টোল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহামুদুল হাসান রাসেল, হেড ক্লার্ক জালাল উদ্দিনসহ তৎকালীন নিযুক্তরা। পরবর্তীতে সওজের কাছে শেখ কামাল সেতুর টোল সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হলে তথ্য না দিয়ে সওজ ক্ষমতাসীন আ.লীগের কাঁধে ভর করে এ প্রতিবেদককে নিউজ না করতে প্রভাবিত করেন।

অনুসন্ধান ও সূত্রমতে, শেখ রাসেল সেতুর টোল আদায়ে চুক্তি মেয়াদের শেষ ৩০ জুন রাত ১২ থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ৩৫০ টাকা টোল আদায় করে সওজ। অথচ ইজারাদার দায়িত্ব হস্তান্তরের দিন ২৪ ঘণ্টায় ৬০ হাজার টাকা আদায় করে। কোটাবিরোধী আন্দোলন দেখিয়ে ৩ আগস্ট ২০ হাজার ৫৫৫, ৪ আগস্ট সরকার পতনের একদফা আন্দোলন দেখিয়ে তিন হাজার ৯৯০ টাকা, ৫ আগস্ট সরকার পতনের দাবি দেখিয়ে মাত্র ৫০০ টাকা এবং ৬ আগস্ট সরকার পতন দেখিয়ে দুই হাজার ৮১৫ টাকা টোল আদায় দেখান। ৩০ জুন থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ৩১ দিনে শেখ রাসেল সেতুতে আট লাখ ২৫ হাজার এবং পরবর্তী জুলাই মাসের ২৫ দিনে ছয় লাখের অধিক টোল আদায় দেখায় সওজ। সূত্রমতে, শেখ রাসেল সেতু থেকে ১১৫ দিনে প্রায় অর্ধকোটি টাকা টোল আদায় করে।

অভিযোগ রয়েছে, ৫০ শতাংশ টোল রাজস্ব খাতে জমা হয়েছে। এদিকে টেন্ডার পদ্ধতিতে নিযুক্ত নতুন ইজারাদার ২৪ অক্টোবর প্রথম দিন ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা টোল আদায় করেন। একই পদ্ধতিতে পার্শ্ববর্তী শেখ জামাল সেতুর টোলেও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ৩০ জুন ইজারাদারের চুক্তি শেষ হলে রাত ১২টা থেকে ১ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩৭ হাজার টাকা টোল আদায় দেখায় সওজ। অথচ দায়িত্ব হস্তান্তরের দিন ৩০ জুন ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ হাজার টাকা টোল আদায় করে ইজারাদার।

সূত্রমতে, ১ জুলাই প্রায় ৫০ হাজার টাকা টোল আদায় হলেও রাজস্ব খাতে জমা হয় ১৫ হাজার ২৪০ টাকা। একইভাবে ৪ আগস্ট চার হাজার ৫০০ এবং ৫ আগস্ট দুই হাজার ৫৫০ টাকা টোল আদায় দেখায় সওজ। ৩০ জুন থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত শেখ জামাল সেতু থেকে ৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা টোল আদায় দেখায় সওজ। এদিকে টেন্ডার পদ্ধতিতে নিযুক্ত নতুন ইজারাদার ১ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় ৪৫ হাজার টাকা আদায় করেন। এছাড়া একই রুটের পার্শ্ববর্তী শেখ কামাল সেতু থেকে ৩ আগস্ট ৯৮ হাজার টাকা, ৪ আগস্ট ৬৩ হাজার এবং ৫ আগস্ট ৩৪ হাজার টাকা টোল আদায় করেন ইজারাদার। শেখ কামাল সেতু থেকে জুলাই মাসে প্রায় ৩৩ লাখ, আগস্টে ৩০ লাখের অধিক এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৩০ লাখের অধিক টাকা টোল আদায়ের তথ্য রয়েছে যুগান্তরের হাতে।

অনুসন্ধান ও সূত্রমতে, কলাপাড়া-কুয়াকাটা রুটের ২০ কিলোমিটার পথে শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল সেতু পাড় হয়ে সব যানবাহনের কুয়াকাটা পর্যটনে পৌঁছতে হয়। ২০ কিলোমিটারের এ সড়কে উল্লেখযোগ্য কোনো বিকল্প সড়ক নেই। যদিও শেখ কামাল সেতুর তুলনায় শেখ জামাল ও রাসেল সেতুর টোল ৫০ শতাংশ কম। এসব তথ্য সংযোজন-বিয়োজনেও মোটা দাগের অর্থ লোপাটের অভিযোগ মেলে অনুসন্ধানে।

অভিযোগ রয়েছে, টোল আদায়ে নিযুক্ত পটুয়াখালী সওজের কর্মচারী একেএম হুমায়ন কবির, তারিকুজ্জমান সৈকত, হাসান ইমাম, এনামুল হক এবং হেড ক্লার্ক জালাল উদ্দিন টোল লুটপাটে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এছাড়া অর্থ ভাগাভাগির সম্মানজনক অংশীদারের তালিকায় নাম রয়েছে পটুয়াখালী সওজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলামসহ কয়েকটি টেবিলের লোকজনের।

অভিযোগ রয়েছে, উপ-সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম প্রটোকল অনুযায়ী ভাগাভাগির অর্থ বিকাশের মাধ্যমে নিতেন। বিকাশে ভাগ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে উপ-সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার পতন আন্দোলনে যান চলাচল কম ছিল এবং পাখিমারা সড়ক খারাপ থাকায় অধিকাংশ যানবাহন শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতু পারাপার হতো না।

তিনি আরও বলেন, ‘টোল আদায়ে সরাসরি নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর হস্তপেক্ষ ছিল, আমি শুধু নামে দায়িত্বে ছিলাম।’ সওজের একটি সূত্র বলছে, নির্বাহী প্রকৌশলী জামিল আক্তার ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামানের পটুয়াখালী নতুন কর্মস্থল হওয়ায় টোলে নিযুক্তরা আর্থিক দুর্নীতির সুযোগ পেয়েছেন।

পটুয়াখালী সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জামিল আক্তার লিমন ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট সরকার পতন আন্দোলনে দুষ্কৃতকারীরা শেখ রাসেল সেতুর টোল প্লাজা ভাঙচুর করে রসিদ বই, রেজিস্টারসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়, যা লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাছাড়া টোল আদায়ে দুর্নীতি হওয়ার কথা নয়। এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ