লাল-নীল ছাতা এবং মাচায় প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে অস্থায়ী অসংখ্য দোকান নদীর তীরজুড়ে। নদীর তীরে রাস্তার দুই পাশে প্রতিটি দোকানেই বাহারি জাতের ফল, পান-সুপারি, হরেকরকম শাকসবজির পসরা সাজানো।
প্রথম দেখাতে যে কেউ মনে করে এটি যেন একটি মেলা; কিন্তু বাস্তবে এটি কোনো বিশেষ উপলক্ষে মেলা নয় বরং নদীর তীরজুড়ে পায়ে হাঁটার রাস্তার নিয়মিত চিত্র। বলছিলাম সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের কথা।
তীর দখল করে যেমন ব্যবসা চলছে, ঠিক তেমনি বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝেও অবৈধ ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পারাপার ও নৌকা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে লঞ্চে যাত্রী তোলার মাধ্যমে টাকা আদায় করা হচ্ছে।
এভাবেই সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদী এবং নদী তীরের রাস্তা দখল করে নিয়মিত ব্যবসা পরিচালনা করছে শ্রমিক লীগের কতিপয় নেতা, নৌ ট্রাফিক নিরাপত্তা ও সদরঘাট নৌ-থানা।
এতে পথচারী এবং যানবাহন চলাচলের ব্যাপক ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে এবং নৌ-পারাপারে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। নৌ পুলিশের সাথে সমন্বয় করে ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো থেকে প্রতিদিন ৩০০ করে টাকা তুলেন নূর হোসেন, বেগুন আলী ও ফারুক নামের কয়েকজন ব্যক্তি। শ্রমিক লীগ নেতা হিসেবেই তারা দীর্ঘদিন পরিচিত এবং বুড়িগঙ্গার মাফিয়া হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তাদের।
এ ব্যাপারে সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহাগ রানা বলেন, নৌকা দিয়ে লঞ্চে যাত্রী উঠানো এবং ইঞ্জিনচালিত নৌকার বেপরোয়া চলাচলের ব্যাপারে আমি অবগত আছি; কিন্তু আমার লোকবল সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারি না। তাছাড়া থানার নৌকাটিও বর্তমানে অচল রয়েছে। চাঁদা উত্তোলনের সাথে আমি কোনভাবেই জড়িত না। অল্প কয়েক দিন হলো আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি। আগের কেউ জড়িত থাকলে সেই ব্যাপারে আমি জানি না।
বুড়িগঙ্গার দুই তীরে পায়ে হাঁটার জায়গা দখল করে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভাসমান দোকানিরা, যারা প্রত্যেকেই শ্রমিক লীগ নেতাদের টাকা প্রদানের মাধ্যমে দোকানের জায়গা বৈধ বলে মনে করেন। তাদের বৈধতার অনুমোদন দিয়েছেন মনির নামের এক ব্যক্তি। মনির হলো বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নদীবন্দর সদরঘাটের সমন্বয় কর্মকর্তা; যার নেতৃত্বে দীর্ঘ ১২ বছর চাঁদাবাজি কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।
মাসখানেক আগে সমন্বয়ক কর্মকর্তা মনির হোসেনের অপকর্ম প্রকাশ হলে তিনি বদলি হয়ে যান এবং নতুন সমন্বয় কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মো. ফরিদ।
মনির বদলি হলেও তার আস্থাভাজন ফরিদ রয়ে গেছেন তার প্রতিনিধি হিসেবে। সাবেক সমন্বয় কর্মকর্তা মনিরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে আগের নিয়মেই টাকা তুলছেন ফরিদ। তিনজন ব্যক্তি নদীর দুই তীরে অবস্থিত দোকানগুলো থেকে দৈনিক এবং সাপ্তাহিক হিসেবে চাঁদা তুলেন বলে জানান ভাসমান দোকানিরা।
চাঁদা উত্তোলনকারী তিনজন হলেন- লাঠি মনির, ডাকোয়া এবং পোর্টার সুমন। নদীর ওই পারে কেরানীগঞ্জের দিকে ৮০টির মতো দোকান আছে এবং সদরঘাটের দিকে শ্যামবাজার থেকে শুরু করে চাঁদপুর ঘাট পর্যন্ত ৩০০টির মতো দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে ন্যূনতম ৫০ থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত দৈনিক ভাড়া তুলেন।
নদীর পাড়ে সড়কে বাজার বসাতে সিটি করপোরেশন অথবা সরকারের কোনো সংস্থা ইজারা কিংবা অনুমোদন দেয়নি। তারপরও অব্যাহত আছে বাজার কার্যক্রম পরিচালনা।
শুধু তাই নয়, ঢাকা নৌ বন্দরের ৪৭টা খেয়াঘাট ইজারা কার্যক্রমও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি ঘাট থেকে মাসিক চার্জের নামে ৫০০০ টাকা করে প্রায় আড়াই লাখ টাকা চাঁদা আদায় করার প্রতিবেদনও রয়েছে মনিরের নামে। এমনকি দুই তীরে বিভিন্ন কোম্পানিকে কিংবা ব্যক্তিকে মৌখিক চুক্তিতে স্পট অনুযায়ী মাসে ৩০, ৪০ ও ৫০ হাজার টাকা করে জমি ভাড়া দিয়েছেন চক্রটি। সদরঘাটের একাধিক টং দোকানি জানান, বিআইডব্লিউটিএর লোকেরা প্রতি মাসে ১২০০ টাকা আর ঘাট ইজারা মালিককে ৩০০০ টাকা দিতে হয়। তা না হলে দোকান ভেঙে ফেলে দেয়। মাঝে মাঝে ভাঙ্গেনও।
চাঁদপুর ঘাটে অস্থায়ী পান সুপারির দোকানের রনি বলেন, এখানে দোকানদারি করতে হলে প্রতিদিনের টাকা প্রতিদিনই পরিশোধ করতে হয়।
ফল বিক্রেতা মাইনুদ্দিন শিকদার বলেন, প্রতিদিন ২০০ টাকা করে দোকান ভাড়া দিতে হয়। সরকারি জায়গায় দখল করে দোকানদারি কেন করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সবজি বিক্রেতা সোলাইমান বলেন, জায়গার ভাড়া ২০০ টাকা করে দিয়ে এখানে বসি। একটা টাকাও কম দেওয়ার সুযোগ নাই। পেঁয়াজ আড়তদার নাসির বলেন, সরকারি জায়গায় আমরা তো আর ফ্রি-ফ্রি বসি না। এখানে বসার জন্য প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে জমা দিতে হয়।
এ ব্যাপারে সদরঘাটে কর্মরত সমন্বয়ক কর্মকর্তা মো. ফরিদের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, নদীর তীর দখল করে অস্থায়ী দোকানগুলো দীর্ঘদিন যাবত পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রায়শই আমরা অভিযান চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করি, কিন্তু পুনরায় আবার বসে। চাঁদা উত্তোলনের বিষয় তিনি বলেন, অতীতে যে সমন্বয় কর্মকর্তা ছিল তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ছিল সত্য। বর্তমানে তেমন চাঁদাবাজি নেই তবে ছোটখাটো অবৈধ লেনদেন হয় সেই বিষয়টি অস্বীকার করব না। দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ চাইলেই একেবারে একদিনে শেষ হয়ে যায় না। তার ওপর আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের দোকান থাকে, সেগুলোর ব্যাপারে চাইলেই কিছু করতে পারি না। বর্তমানে চাঁদাবাজি অনেক কমে এসেছে, একেবারে যেন আর না হয় সেই বিষয়ে আমরা সর্বাধিক তৎপর থাকব।
সদরঘাট টার্মিনালের পোর্ট অফিসার গোলাম কবির জানান, নৌ নিরাপত্তার বিষয়গুলো সম্পূর্ণ নৌ পুলিশের কাজ। রাস্তার পাশের দোকানগুলো সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে পরিচালিত হয়; এখান থেকে কেউ চাঁদা তুললে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু নদীর পাশের যে সমস্ত দোকান রয়েছে, সেগুলো নদী বন্দরের নিয়ন্ত্রাধীন। এসব দোকান উচ্ছেদ কার্যক্রম আমরা প্রায়শই পরিচালনা করে থাকি। এসব দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করার ব্যাপারে তিনি প্রতিদিনই উচ্ছেদ অভিযান চালান বলে জানান। তিনি আরও জানান, একদিকে উচ্ছেদ করি, অন্যদিকে এসে বসে পড়ে। এদের স্থায়ী পুনর্বাসন করে সম্পূর্ণ ফুটপাত দখলমুক্ত করা প্রায় অসম্ভব।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, মনিরের বিভিন্ন অপকর্ম সম্পর্কে জানার পরই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাকে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে চাঁদা উত্তোলনের ব্যাপারে আমি অবগত নই। যদি অভিযুক্ত বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের চাঁদাবাজির সত্যতা পাওয়া যায়, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে। তাছাড়া অস্থায়ী দোকানগুলোর পজিশন সম্পর্কে আমার অজানা। শিগগিরই সরেজমিন আমরা পরিদর্শন করব। যদি দোকানগুলো নদীবন্দরের জায়গায় অবস্থিত হয়, তবে সেগুলো উচ্ছেদ করে জনসাধারণের চলাফেরার জন্য সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করব।