শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন

সীমান্ত বাণিজ্য কমিশনের শর্তে আটকে রাখা পণ্যবাহী কার্গো ছাড়বে আরকান আর্মি

শহীদুল ইসলাম শাহেদ ,টেকনাফ (কক্সবাজার)
  • প্রকাশের সময়ঃ সোমবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ২২ প্রদর্শন করেছেন

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের ভাব থাকলেও রাখাইনের টাউনশিপ মংডু আরাকান আর্মির দখলের পর অচল হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত স্থলবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। মূলত সীমান্তে নৌপথে আরাকান আর্মির প্রতিবন্ধকতায় স্থলবন্দরে পণ্যবাহী ট্রলার আসছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

সর্বশেষ দেড়মাস পর গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে স্থলবন্দরে আসার পথে নাফনদীর মোহনায় পণ্যবাহী তিনটি কার্গো বোট আটকে রেখেছে সংগঠনটি। এসব বোটে ৫০ হাজার বস্তা পণ্য রয়েছে। তিন দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও রবিবার (১৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত পণ্যবাহী কার্গো তিনটি মংডু খায়ুংখালী খালে আরাকান আর্মির হেফাজতে রয়েছে।

এ বিষয়ে টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন বলেন, এখনও পণ্যবাহী কার্গোগুলো ছেড়ে দেয়নি আরাকান আর্মি। এ ঘটনার পর থেকে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কের মধ্য রয়েছেন। কেননা, এর আগে থেকে সে দেশের সংঘাতের কারণে ব্যবসায়ীরাদের পণ্য আসা কমেছিল। তবে এই সমস্য সমাধানে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। অন্যথায় টেকনাফ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে, মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যে মংডু টাউনশিপ আরাকান আর্মির দখলে নেয়। এরপর থেকে কোনও পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে আসেনি। সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে ৩ ডিসেম্বর টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ এসেছিল।

স্থলবন্দর একাধিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেড় মাস পর মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে গত শনিবার সে দেশের ব্যবসায়ী তারুয়া মিতা, সৌ টাংসহ কয়েকজন ব্যবসায়ীর পণ্যবাহী কার্গো বোট টেকনাফ স্থলবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়। পাচ দিনের মাথায় কার্গোগুলো গত বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় নাফ নদের মোহনায় মিয়ানমারের জলসীমায় তল্লাশির নামে কার্গো তিনটি আটকে দেয় আরাকান আর্মি। সেখানে ৫০ হাজারের বেশি বস্তা মালামাল রয়েছে। এর মধ্য আচার, শুঁটকি, সুপারি, কফিসহ বিভিন্ন মালামাল রয়েছে। স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী শওকত আলী, ওমর ফারুক, মো.আয়াছ, এম এ হাসেম, মো. ওমর ওয়াহিদ, আবদুর শুক্কুর সাদ্দামসহ অনেকের মালামাল সেখানে রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে টেকনাফ স্থলবন্দরের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন,পণ্যবাহী কার্গোগুলো এখনও আরাকান আর্মির হেফাজতে রয়েছে। আশা করি খুব দ্রুত এটির সমাধান হবে। সেখানে প্রায় ৩০-৪০ কোটি টাকার মালামাল রয়েছে। যেখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে সরকার।’

তিনি আরও বলেন,মিয়ানমারে সংঘাতের পর থেকে সীমান্তে বাণিজ্য করা ব্যবসায়ীরা খুব বিপদে রয়েছেন। অনেকে পণ্যের জন্য ডলার পাঠানোর পর যুদ্ধের কারণে মালামাল আনতে পারছেন না। এতে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েছেন। অনেক ব্যসায়ী টেকনাফ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন। তাই সরকারের উচিত মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলে দুই দেশের স্বার্থে সীমান্ত বাণিজ্য সচল রাখা।

কেন আটক হলো পণ্যবাহী কার্গো?
মিয়ানমারে ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত আরাকান আর্মি দখলের নেওয়ার পর থেকে ভয়ভীতিতে ছিল সীমান্ত ব্যবসায়ীরা। আরাকান আর্মি নিজেদের রাষ্ট্র ঘোষণা করে বাণিজ্যে ভাগ বসানোর চেষ্টায় ছিল তখন থেকে। তারই অংশ হিসেবে গত ১৬ জানুয়ারি টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে পণ্যবাহী কার্গোগুলো আটক করেছে বলে জানিয়েছেন স্থলবন্দরের এক ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, পণ্যবাহী কার্গোগুলো আটকের পর থেকে সে দেশের ব্যবসায়ীরা তাদের (আরাকান আর্মির) সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছে। শুরুতে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও এখন তারা এই পণ্য থেকে লেনদেনের ভাগ চায়।

সীমান্ত বাণিজ্য ভাগ চায় আরাকান আর্মি
যেহেতু তাদের জলসীমা হয়ে বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রলার আসছে সেই সুযোগই কাজে লাগাতে চাচ্ছে আরাকান আর্মি। এমনটা জানিয়ে কক্সবাজার চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘আরাকান আর্মি এখন সীমান্ত বাণিজ্যে ভাগ বসাতে চায়। তার কারণে পণ্যবাহী ট্রলারগুলা আটক রেখেছে। কমিশন (টাকা) পেলে ছেড়ে দেবে। কারণ, এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। ইতোমধ্যে তাদের (আরাকান আর্মি) পারমিট নিয়ে ট্রলার আসতেছে। তাই দুই দেশের স্বার্থে সেখানকার ব্যবসায়ীদের উচিত তাদের সঙ্গে বসে এটার স্থায়ী সমাধান করা। অন্যথায় সীমান্তে বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রলার আসতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পর থেকে তাদের জলসীমা দিয়ে পার হতে হয়। যেটি বর্তমানে আরাকান আর্মির দখলে। তাই তারা পণ্যবাহী কার্গো বোটগুলো আটকানোর সুযোগ পেয়েছে। আরাকান আর্মি তাদের জলসীমা থেকে পারমিট না দিলে পণ্যবাহী কোনও ট্রলার এখানে (স্থলবন্দরে) আসার সুযোগ নেই। সেটিকে কাজে লাগিয়ে তারা সীমান্ত বাণিজ্যে ভাগ বসানোর চেষ্টা করছে।’

স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী শওকত আলম বলেন, স্থলবন্দরে পণ্যবাহী কার্গো পৌঁছেনি। এখনও আরাকান আর্মির হেফাজতে রয়েছে সেগুলো। আমাদের ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করছে সমাধানের। এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মাঝে শঙ্কা নেমে এসেছে। সরকারেরও উচিত এটি সমাধানের এগিয়ে আসা।’

সরেজমিনে টেকনাফ সদরের কেরুনতলী এলাকায় স্থলবন্দরে কোনও মানুষজনের দেখা মেলেনি। জেটিঘাটগুলো ফাঁকা দেখা গেছে। তবে কাঠের পয়েন্টে মিয়ানমার থেকে আসা ছোট একটি কাঠের ট্রলার খালাস করছেন শ্রমিকরা।

কাঠের ট্রলার নিয়ে আসা আবু সুফিয়ান মাঝি বলেন, কাঠের ট্রলার নিয়ে কাল (শনিবার) স্থলবন্দরে পৌঁছেছি। আসার পথে নাফ নদের জলসীমানা মংডু কায়ুংখালী খালের পাশে তিনটি পণ্যবাহী কার্গো বোট আরাকান আর্মির হেফাজতে দেখেছি। কিন্তু আমাদের ট্রলার থামাতে বলেনি। কারণ, তাদের সঙ্গে মালিকের বোঝাপড়া রয়েছে।’

স্থলবন্দরের মাঝি মো. শামসু বলেন, স্থলবন্দরে কোনও কাজ নেই। পুরো জায়গা খালি পড়ে আছে। শ্রমিকদের বেকার সময় যাচ্ছে। কয়েকদিন ধরে তিনটি কার্গো বোট আসার কথা ছিল। সেগুলোও আটক করেছে আরাকান আর্মি। তা ছাড়া গতকাল ছোট একটি কাঠের ট্রলার এসেছিল বন্দরে। সেটি খালাস চলছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে আশিকুর রহমান।
তিনি বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে মিয়ানমার জলসীমায় পণ্যবাহী কার্গো বোটে তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলে শুনেছি। তবে এটি আমাদের জলসীমার বাইরে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ