সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:১৫ অপরাহ্ন

হৈল বাবা কুড়িখাঁই, নাচতে-নাচতে বেস্তে যাই

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ১৮ প্রদর্শন করেছেন

‘হৈল বাবা কুড়িখাঁই, নাচতে-নাচতে বেস্তে যাই’। কুষ্টিয়ার লালন উৎসব-মেলার পর সাধু-সাধক, পীর-ফকিরদের উপস্থিতিতে দেশের অন্যতম বৃহত্তম কুড়িখাঁই মেলা অভিমুখী কাফেলা থেকে এমন উচ্চারণ শোনা যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা, আশপাশের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে দর্শনার্থীদের এমন কাফেলা।

শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনে বিশাল এ মেলার আয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে সাধক-ফকির এবং বাউলদের গান-বাজনার আসর বসলেও শেষপর্যন্ত জামাই-বউয়ের মাছের মেলা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। এ আনন্দ আয়োজন ও প্রাণের মেলায় অংশ নিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। মাছের ক্রেতারা হচ্ছেন- বিভিন্ন স্থানে বিয়ে দেওয়া কটিয়াদী উপজেলার জামাইরা। এবার মেলায় বিশাল বিশাল মাছের সম্ভার নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। একেকটি মাছ দুই লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে জানান অনেকে।

অনেকটা তীর্থ জ্ঞান করে ওরস উপলক্ষে আয়োজিত আটশ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুড়িখাঁইয়ের কামেল পিরের মাজারের এ বিশাল আঙিনায় সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে। দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ সাত দিনই হাজারও নারী-পুরুষের কাফেলায় কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার সব পথ যেন মিশে যায় কুড়িখাঁই মেলায়।

সোমবার ভাঙছে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রাণের মেলবন্ধন এ মেলা।

এবার এ মেলায় আসা সাধু-সাধক, পির-ফকিরের সঙ্গে সমাগম ঘটেছে অনেক কবি-সাহিত্যিক ও চারুকলা শিল্পীরও। তারা পছন্দের সাধু-সাধকদের সামনে কাছে বসিয়ে ক্যানভাসে রঙ-তুলির আঁচড় কাটছেন। আঁকছেন অবিকল নান্দনিক সব পোট্রের্ট।

এদের মধ্যে ওই এলাকারই কৃতীসন্তান দেশবরেণ্য কবি আবিদ আনোয়ারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দুরন্ত শৈশব-কৈশোর থেকেই এ কুড়িখাঁই মেলায় আসা-যাওয়া। মূলত ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে এখানে আধ্যাত্মিক সাধক শাহ সামসুদ্দিন বুখারির (র.) ওরস উপলক্ষে তার মাজার আঙিনায় বসে সপ্তাহব্যাপী এ প্রাণের মেলা। আর ওই ওরস ও মেলার সার্থকতা এখানেই যে, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ পরিবারের ছোটবড় সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে উপভোগ করতে আসেন। ঢল নামে বিভিন্ন বয়সের লাখো নারী-পুরুষের। গান-বাজনা, আজান-নামাজ, ইবাদত-প্রার্থনা এবং চিত্তের বিকাশ-মনোরঞ্জনের ব্যাকুলতা মানুষ হিসেবে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মুমুরদিয়া ইউনিয়নে জমে ওঠেছে ঐতিহ্যবাহী এ কুড়িখাঁই মেলা। লাখো দর্শনার্থী, আগন্তুক, সাধক-ফকির ও বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত হয়ে ওঠেছে এ মেলা।

বসেছে মৃৎশিল্প, বাঁশ বেত শিল্পের ব্যবহার্য সামগ্রীর পাশাপাশি, বিন্নি খৈ, কদমা (তিলুয়া), বাতাসা, জিলাপি, নানান রকমের মিষ্টির দোকান। রয়েছে নাগর দোলা, যাদু, মোটরসাইকেল খেলার মৃত্যুকূপ, সার্কাস, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন।

তবে মেলা সংস্কৃতির প্রসার দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন এ মেলায় আসা অনেক ব্যবসায়ী। তাদের অভিযোগ, ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের অনেক মেলা আয়োজনকে বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ নির্বিবাদে চলছে নানা স্পর্শকাতর বিষয়ের মোড়কে নানা ধরনের অবাঞ্ছিত সব অনুষ্ঠান।

জানা গেছে, বছরের প্রতি মাঘ মাসের শেষ সোমবার থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সাত দিন চলে এই মেলা। আধ্যাত্মিক সাধক শাহ সামসুদ্দিন বুখারির (র.) মাজারে ওরস উপলক্ষে বসে এ মেলা।

কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইয়ের মাজারের পর দেশের অন্যতম বৃহত্তম এই প্রাণের মেলায় এ জেলার লোকজনের পাশাপাশি দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লাখো দর্শনার্থী, আগন্তুক ও আধ্যাত্মিক সাধক-ফকির এমনকি বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের সমাবেশ ঘটে।

জনশ্রুতি আছে, ১২ জন আউলিয়ার সঙ্গে প্রায় ৮০০ বছরেরও আগে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসা আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহ সামসুদ্দিন আওলিয়া সুলতানুল বুখারী (র.) এই এলাকায় আসেন। তার দেহ ত্যাগের পর গড়ে উঠা মাজারের ওরসকে কেন্দ্র করে কালক্রমে কুড়িখাঁই মেলার গোড়াপত্তন হয়।

আর প্রতি বছরের মতোই সোমবার থেকে বসেছে ওই কুড়িখাঁই মেলা। এ উপলক্ষে মাজারসংলগ্ন বিশাল প্রাঙ্গণজুড়ে শিশু-কিশোরদের নানারকম বিনোদনমূলক বাহন, খেলনা, মাটি, বাঁশ-বেত ও কাটের কুটির শিল্পজাত সামগ্রী এবং বিন্নি খৈ, জিলাপি, খেলনা মিষ্টি, হাওয়াই মিষ্টিসহ বাহারি সব মুখরোচক ঐতিহ্যবাহী খাদ্য সম্ভারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।

একই সঙ্গে একপ্রান্তে বসেছে দুর্লভ ও নানা প্রজাতির মাছের বিরাট মেলা। এ মেলায় কোনো কোনো মাছ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত মূল্যেও বিক্রি হয়। আর এসব মাছের ক্রেতা হচ্ছেন- বিভিন্ন স্থানে বিয়ে দেয়া কটিয়াদী উপজেলার মেয়েদের স্বামীরা। অপরদিকে মেলার অন্য প্রান্তজুড়ে বসেছে সাধক-ফকির-বাউলদের গান-বাজনা ও গঞ্জিকা সেবনের প্রকাশ্য আসরও।

কথিত আছে, শাহ শামসুদ্দিন আউলিয়ার ভক্ত বোখারার কুড়িখাঁ নামে এক সুলতান এই এলাকায় আসেন। পরবর্তীতে ওই সুলতানের নামানুসারে এলাকাটির নাম হয়ে ওঠে কুড়িখাঁই। এ প্রাণের মেলায় অংশ নিতে আসা দেশবরেণ্য কবি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক কবি আবিদ আনোয়ার মনে করেন, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির মূল বার্তা হলো অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আর এসব মেলা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মেলবন্ধন। সুতরাং এসব মেলা আয়োজনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ