শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ১১:৩৮ অপরাহ্ন

গ্রেফতারের পর কারাগারে ব্যাংক খাত ধ্বংসের কারিগর বারাকাত

প্রতিবেদকের নামঃ
  • প্রকাশের সময়ঃ শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫
  • ৩ প্রদর্শন করেছেন

জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতকে দুদকের মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার বিকালে শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানা এ আদেশ দেন। এদিন দুপুর ২টা ২২ মিনিটের দিকে আসামিকে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় হাজির করা হয়। এরপর দুপুর ২টা ৪৯ মিনিটের দিকে আদালতের এজলাসে তোলা হয় বারাকাতকে।

জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে আলোচিত অ্যাননটেক্স গ্রুপকে দেওয়া ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আবুল বারাকাতকে গ্রেফতার করা হয়। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগপন্থি এই অর্থনীতিবিদ ক্ষমতাচু্যত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসাবে সবার কাছে বেশ পরিচিত ছিলেন

২২ মে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঋণ জালিয়াতি মামলায় আবুল বারাকাত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করে।

এ মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আবুল বারাকাতের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জড়িত, ঋণ পেতে ও আত্মসাতে ‘সহায়তা’ করার অভিযোগ রয়েছে দুদকের মামলায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তার সময়ে অ্যাননটেক্সকে বিতরণ করা ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ এখন শুধুই জনতা ব্যাংকের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির জন্য এক দুঃসহ দায়।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান শুক্রবার যুগান্তরকে জানান, ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যারা দায়ী, তাদের সবাইকে পরিচয় ও অবস্থান নির্বিশেষে জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে। বিশেষ করে যে ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে, তার সিংহভাগের ক্ষেত্রেই সংশি্লষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বললেই চলে।

সুষ্ঠু তদনে্তর স্বার্থে প্রয়োজনে অভিযুক্তকে আটক করার বৈধতাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে যেভাবে সাবেক চেয়ারম্যানকে গভীর রাতে আটক করা হয়েছে, তা শুধু প্রশ্নবদ্ধিই নয়, প্রতিশোধপ্রবণ, হয়রানিমূলক এবং বিচারের আগেই শাসি্ত দেওয়ার সমতুল্য, যা দুদক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পরিহার করা উচিত ছিল।

২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে দুই মেয়াদে আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রথম দায়িত্ব পেয়েছেন ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহাল ছিলেন। সে সময়ে ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ পান অ্যাননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুস (বাদল)। তার মূল ব্যবসা বস্ত্র উত্পাদন ও পোশাক রফতানি। ওই সময় ব্যাংকপাড়ায় আলোচনা নতুনভাবে চলে আসে জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি মূল ব্যক্তি ছিলেন বারাকাত।

জনতা ব্যাংকের নিয়মবহির্ভূত ঋণ দেওয়ার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তত্কালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছিলেন, ‘আবুল বারাকাত (জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান) এত টাকা দিয়েছেন, আমি তো জানিই না। তবে আমি জানি যে তার সময়ে বড় বড় বেনামি ঋণ দেওয়া হয়েছে।’

দুদকের মামলার এজাহার অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অ্যাননটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড জনতা ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে ঋণ নিয়েছে। তবে মূলত বড় অঙ্কের বিতরণ ঘটে ২০১৩-১৪ সময়কালে, অর্থাত্ যখন আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন।

দুদকের মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, অ্যাননটেক্সের জমির অস্বাভাবিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ হয়েছে। ৩ কোটি টাকার জমিকে ১৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকায় অতিমূল্যায়ন করে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়, যা এখন আত্মসাতের অভিযোগে আলোচিত।

অ্যাননটেক্স গ্রুপের অনুকূলে অনুমোদিত এ ঋণের বড় অংশ, বিশেষত ১৮০ কোটি টাকার একটি প্যাকেজ সুপ্রভ স্পিনিংয়ের নামে বিতরণ হয় ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। তদন্তে দেখা যায়, এ ঋণের একটি বড় অংশ (৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা) অ্যাননটেক্সের গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়, যা সরাসরি অর্থ আত্মসাতের শামিল বলে মনে করছে দুদক।

জানা যায়, অ্যাননটেক্সের বাইরেও বারাকাত ব্যাংক খাতে নানা ধরনের অপতত্পরতা চালিয়েছেন। জঙ্গি কার্যক্রমের তকমা দিয়ে অনেক ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের নেপথ্যে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত হলেও তার নেতৃত্বে জনতা ব্যাংকে বিতরণ করা এই ঋণ এখন কেলেঙ্কারির বড় উদাহরণ। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকাকালীন তার নেতৃত্বে নেওয়া অনেক সদ্ধিান্তই এখন প্রশ্নবদ্ধি। অ্যাননটেক্সের মতো প্রতিষ্ঠানকে এত বড় অঙ্কে অর্থায়ন করা এবং কোনো কার্যকর মূল্যায়ন ছাড়া তা অনুমোদন দেওয়া প্রমাণ করে তিনি ‘ব্যাংকের স্বার্থ নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্য ও প্রভাবকে’ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে জনতা ব্যাংকের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে।

বর্তমান ব্যাংকের ৫৫ শতাংশ ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে ১০ শিল্পগ্রুপের কাছে। ৬১ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। সর্বশেষ হিসাবে ২০২৪ সালে মোট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের ৬২ কোটি টাকার মুনাফার বিপরীতে ভয়াবহ বিপর্যয়।

সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যাংকটি পরিচালনা করতে হচ্ছে। অনেক বেশি ছিল খেলাপি ঋণ এবং লোকসানের অঙ্ক। সেখান থেকে তুলে আনার চষ্টো চলছে প্রতিনিয়তই।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ