সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩১ জন, আহত হয়েছেন অন্তত ১৬৫ জন।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর আলোচনায় উঠে এসেছে যে যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল, তার ধরন, কাঠামো, প্রযুক্তি, জ্বালানি ও নিরাপত্তা—সব কিছু। এফটি-৭ বিজিআই নামের সেই যুদ্ধবিমানটিকে ঘিরে জনমনে একাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এই লেখায় সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিমানটির গঠনকাঠামো ও বৈশিষ্ট্য
দুর্ঘটনার পর একাধিক সংবাদমাধ্যম বিমানটির মডেল উল্লেখ করে ‘এফ-৭ বিজিআই’ হিসেবে। তবে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সঠিক নাম এফটি-৭ বিজিআই। যদিও এটি প্রশিক্ষণেও ব্যবহৃত হতো, তবে আইএসপিআর স্পষ্ট করে বলেছে, এটি ছিল আসলেই যুদ্ধের উপযোগী একটি ফাইটার জেট।
বিমানটির নকশা ও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এর শিকড় ছড়িয়ে আছে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার সোভিয়েত যুদ্ধবিমান মিগ-২১-এর (MiG-21) মধ্যে। ১৯৬০-এর দশকে এই বিখ্যাত বিমানটির ছাঁচ ধরেই চীন তৈরি করে চেংদু জে-৭ (Chengdu J-7)। পরে এই জে-৭ এর উন্নত সংস্করণ হিসেবে আসে এফ-৭ সিরিজের বিমান। আর এই সিরিজের সবচেয়ে উন্নত ও শেষ মডেল হলো এফটি-৭ বিজিআই।
২০১১ সালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে এই বিমান কেনার চুক্তি হয়। ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’ জানায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী হাতে পায় বিমানগুলো। এরপর চীন এই সিরিজের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। বিজিআই বলতে বোঝানো হয় Bangladesh Glass-cockpit Improved—অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করা একটি কাস্টম ডিজাইনড যুদ্ধবিমান।
কী আছে এফটি-৭ বিজিআই-এর ভেতরে?
এই যুদ্ধবিমানের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪.৮৮ মিটার, উচ্চতা ৪.১ মিটার এবং পাখার বিস্তার ৮.৩২ মিটার। এটি সুপারসনিক স্পিডে, ঘণ্টায় ২৭০০ কিলোমিটার (ম্যাক ২.২) বেগে উড়তে পারে।
মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে ডেল্টা উইং ডিজাইনে—ত্রিভুজাকৃতি পাখা যা উচ্চগতিতে বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এতে রয়েছে চীনের তৈরি লিয়াং ওপেন-১৩এফ আফটারবার্নিং টার্বোজেট ইঞ্জিন, যা ৪৪.১ থেকে ৬৫ কিলোনিউটন থ্রাস্ট দিতে পারে। একে বলা যায়, পুরো যুদ্ধবিমানের প্রাণ।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এর ডিজিটাল ককপিট। তিনটি রঙিন মাল্টি-ফাংশনাল ডিসপ্লে (MFD) পাইলটকে এক নজরে গতি, উচ্চতা, রাডার ও ইঞ্জিন অবস্থা জানিয়ে দেয়। আর হটাস (HOTAS) প্রযুক্তির কারণে পাইলট হাত না সরিয়েই অস্ত্র চালাতে পারেন।
বিমানটির চোখ হিসেবে কাজ করে কেএলজে-৬এফ রাডার, যা ৮০–৮৬ কিমি দূর পর্যন্ত একাধিক লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারে। জরুরি অবস্থায় পাইলটকে রক্ষা করতে আছে মার্টিন-বেকার এমকে-১০এল ইজেকশন সিট।
বারবার কেন দুর্ঘটনার কবলে?
দেখা যাচ্ছে, এফ-৭/জে-৭ সিরিজের যুদ্ধবিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে একাধিক দেশে—পাকিস্তান, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, ইরান ও এমনকি চীনেও। বাংলাদেশেও ২০১৮, ২০১৯, ২০২৩ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে এই সিরিজের বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানটির আপগ্রেড হলেও এর মূল কাঠামো পুরনো সোভিয়েত মডেল হওয়ায় কিছু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েই গেছে। বিশেষ করে এর ডেল্টা উইং ডিজাইন, যা অবতরণের সময় নিয়ন্ত্রণ কঠিন করে তোলে। স্বল্প গতিতে এই পাখার ওপর বাতাসের গতি বিঘ্নিত হয়, ফলে সৃষ্টি হয় ‘ফ্লো সেপারেশন’, যা নিয়ন্ত্রণ হারানোর অন্যতম কারণ।
এ অবস্থায় বিমান স্টল (stall) করলে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়া পাইলটের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে নিরাপদ অবতরণে বিশেষ দক্ষতা এবং অনুশীলন প্রয়োজন হয়। যদিও এই ঘটনার প্রকৃত কারণ হিসেবে আইএসপিআর ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ উল্লেখ করেছে, বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি।
জ্বালানি: নীরব বিপদ
এই বিমানে ব্যবহৃত হয় অ্যাভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল (জেট ফুয়েল), যা সাধারণ গাড়ির জ্বালানির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও দাহ্য। এটি মূলত কেরোসিনভিত্তিক, উচ্চ ঘনত্বের হাইড্রোকার্বনের মিশ্রণ।
জেট ফুয়েলের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট মাত্র ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা মানুষের শরীরের গড় তাপমাত্রার প্রায় সমান। অর্থাৎ স্বাভাবিক পরিবেশেই এটি অনায়াসে দগ্ধ হতে পারে।
এক লিটার জেট ফুয়েল পোড়ালে ৩৫ মেগাজুল শক্তি উৎপন্ন হয়, যা গাড়ির জ্বালানির তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। টার্বোজেট ইঞ্জিনে যখন এই জ্বালানি মিশিয়ে দেওয়া হয়, তখন এর বিক্রিয়া বিস্ফোরণের মতো শক্তি তৈরি করে।
কিন্তু দুর্ঘটনার সময় এই শক্তি হয়ে উঠতে পারে মারণাস্ত্র। ইঞ্জিন বা ট্যাংকে ফাটল দেখা দিলেই ফুয়েল বেরিয়ে আসে এবং অক্সিজেনের সংস্পর্শে মুহূর্তেই জ্বলে ওঠে। তখন তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ১১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে—যা ধাতব কাঠামো পর্যন্ত গলিয়ে দিতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে মানুষের শরীর যে টিকবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেষ কথা
এফটি-৭ বিজিআই একটি আধুনিক যুদ্ধবিমান, তবে তার ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো নকশার ওপর। এর ডিজিটাল ককপিট, উন্নত রাডার ও ইঞ্জিন—সবকিছুই উন্নত, কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতা ও জ্বালানির অতিরিক্ত দাহ্যতা এই বিমানটিকে বিপজ্জনক করে তুলেছে।
মাইলস্টোনের দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিল, প্রযুক্তির বিকাশ যতই হোক, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না থাকলে তা মুহূর্তেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। যেসব পরিবার প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের ক্ষতি কোনো ভাষায় পূরণ করা সম্ভব নয়।