পাক-ভারত, ইউক্রেন-রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য সংকটসহ চলমান বৈশ্বিক উত্তেজনার মধ্যেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। দেশ দুটির মধ্যে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সীমান্ত সংঘর্ষ চলছে তিনদিন ধরে। বিতর্কিত সীমান্তে উভয় দেশই ভারি আর্টিলারি হামলা চালাচ্ছে, যার ফলে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩২ জন নিহত ও ১৩০ জন আহত হয়েছেন এবং কয়েক লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
কীভাবে শুরু হলো উত্তেজনা?
২০২৫ সালের মে মাসে দুই দেশের সীমান্তে গুলির সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ে এক কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হন। মূলত এরপর থেকেই ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। কূটনৈতিক উত্তেজনার পরিণতিতে বর্তমানে শুরু হয়েছে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ।
বর্তমানে কী ঘটছে?
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) ভোরে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় একটি প্রাচীন মন্দির সংলগ্ন বিতর্কিত এলাকায়। এরপর দ্রুত লড়াই ছড়িয়ে পড়ে সীমান্তের অন্যান্য অংশেও এবং শনিবার পর্যন্ত টানা তৃতীয় দিনের মতো ভারি গোলাগুলি চলেছে।
থাইল্যান্ড ইতোমধ্যেই তাদের রাষ্ট্রদূতকে নমপেন থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে এবং কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে। কারণ হিসেবে তারা জানায়, একজন থাই সেনা সদ্য পাতা ল্যান্ডমাইনে পা হারিয়েছেন, যা থাইল্যান্ডের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী বসিয়েছিল। কম্বোডিয়া অবশ্য এ অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
উভয় পক্ষই একে অপরকে প্রথম গুলি চালানোর জন্য দায়ী করছে। এ পর্যন্ত সংঘর্ষে উভয় পক্ষে অন্তত ৩২ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন ১৩০ জন, যাদের মধ্যে ৫০ জন কম্বোডিয়ান বেসামরিক নাগরিক ও ২০ জন সেনা সদস্য রয়েছে।
হামলায় কম্বোডিয়া ট্রাক-মাউন্টেড রকেট লঞ্চার ব্যবহার করছে, যা থাইল্যান্ডের মতে বেসামরিক এলাকাকে লক্ষ্য করছে। জবাবে থাই সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্র-নির্মিত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে এবং সীমান্তের ওপারে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণ করেছে।
এ উত্তেজনার মধ্যেই থাইল্যান্ডের প্রায় ১.৩ লাখ মানুষকে সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নেওয়া হয়েছে এবং কম্বোডিয়ার প্রায় ১২,০০০ পরিবারকে ফ্রন্টলাইন থেকে সরে যেতে হয়েছে।
বিরোধের মূল উৎস কী?
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থলসীমান্তের বহু অংশে শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিরোধে জড়িত। ১৯০৭ সালে কম্বোডিয়া যখন ফরাসি উপনিবেশ ছিল, তখন একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়। সেখানে বলা হয়, প্রাকৃতিক জলবিভাজিকা রেখা ধরে সীমান্ত নির্ধারণ হবে। থাইল্যান্ড পরে এ মানচিত্রকে চ্যালেঞ্জ করে।
২০০০ সালে দুই দেশ যৌথ সীমান্ত কমিশন গঠন করে শান্তিপূর্ণভাবে সীমান্ত বিরোধ মেটানোর উদ্যোগ নেয়, তবে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।
২০০৩ সালে একটি থাই সেলিব্রিটির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে কম্বোডিয়ার আংকোর ওয়াট মন্দিরের অধিকার নিয়ে জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা এতটাই বেড়ে যায় যে, নমপেনে থাই দূতাবাস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
অতীতের সংঘর্ষের ঘটনাগুলো কী?
১১শ শতকের হিন্দু মন্দির প্রোহ বিহার (থাই ভাষায় ‘খাও প্রা বিহান’) যুগ যুগ ধরে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) এই মন্দির কম্বোডিয়ার হাতে তুলে দেয়। তবে থাইল্যান্ড মন্দিরটি ঘিরে থাকা জমির ওপর এখনো দাবি জানিয়ে আসছে।
২০০৮ সালে কম্বোডিয়া যখন প্রোহ বিহারকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে চায়, তখনই উত্তেজনা বাড়ে। ২০১১ সালে এক সপ্তাহের গোলাগুলিতে অন্তত ১২ জন নিহত হন।
২০১৩ সালে কম্বোডিয়া ICJ-কে পূর্ববর্তী রায়ের ব্যাখ্যার অনুরোধ জানায় এবং আদালত আবারও তাদের পক্ষে রায় দেয়, বলেছিল মন্দির সংলগ্ন জমিও কম্বোডিয়ার অংশ। থাইল্যান্ডকে সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বর্তমান উত্তেজনার পেছনে কারণ কী?
পুরনো বিরোধ থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সরকারগুলোর মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক দেখা গেছে, বিশেষ করে প্রাক্তন দুই নেতা থাকসিন সিনাওয়াত্রা (থাইল্যান্ড) ও হুন সেন (কম্বোডিয়া)-এর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে।
তবে ২০২৪ সালে থাইল্যান্ডে রক্ষণশীলদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়, যখন সরকার কম্বোডিয়ার সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংলগ্ন এলাকা থেকে যৌথভাবে জ্বালানি অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করে। সমালোচকেরা আশঙ্কা করেন, এর ফলে থাইল্যান্ড উপসাগরের কো কুদ দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরও উত্তেজনা ছড়ায়, যখন একদল কম্বোডিয়ান নাগরিক সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে থাই-মালিকানাধীন প্রাচীন মন্দির তা মোয়ান থম-এ জাতীয় সংগীত গেয়ে প্রবেশ করে। থাই সেনারা তখন তাদের থামিয়ে দেয়।
থাই প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা (থাকসিনের কন্যা) কম্বোডিয়ার প্রেসিডেন্ট হুন সেনকে ফোন করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায় এবং পরে হুন সেন সেটি পুরোপুরি প্রকাশ করে দেন।
ফোনে প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন একজন সেনা কর্মকর্তার সমালোচনা করেন এবং হুন সেনের প্রতি অতি বিনয় দেখান—যা জনরোষের জন্ম দেয় এবং থাই সিনেটরদের অভিযোগের ভিত্তিতে ১ জুলাই তাকে আদালত সাময়িক বরখাস্ত করে।
সমাধানের কোনো প্রচেষ্টা চলছে কি?
গত ২৮ মে-র সংঘর্ষের পর দুই দেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানের অঙ্গীকার করেছিল এবং ১৪ জুন একটি যৌথ সীমান্ত কমিশনের বৈঠকে বসে। তবে বাস্তবে উভয় পক্ষই সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করেছে।
কম্বোডিয়া জানিয়েছে, বিদ্যমান আলোচনার কাঠামো কার্যকর নয় এবং তারা চারটি সীমান্ত অঞ্চল সংক্রান্ত বিরোধ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে তুলে ধরবে।
এদিকে থাইল্যান্ড আদালতের রায় মানতে রাজি নয়। তারা মূলত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান চায়।
বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষের পর কম্বোডিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চিঠি পাঠিয়ে অভিযোগ করেছে, থাইল্যান্ড ‘অভিপ্রেত ও উস্কানিমূলক সামরিক আগ্রাসন’ চালিয়েছে।
অন্যদিকে থাইল্যান্ড বলছে, কেবল তখনই আলোচনা হতে পারে, যখন কম্বোডিয়া সহিংসতা বন্ধ করবে।