রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের লার্ণিং সেন্টারে শিক্ষাকেন্দ্র চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের চাকরিতে পূনর্বহালের দাবিতে আজ বুধবার সকাল থেকে আবারও আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষকেরা কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েকটি প্রবেশমুখে চাকরিচ্যুত শিক্ষরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সকালের দিকে আন্দোলনকারীদের নিভৃত করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। পরে ঘটনাস্থল থেকে শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সকাল ৮ টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষকেরা উপজেলা সদরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়ে এনজিওর যানবাহন প্রবেশে বাধা দেয়। এসময় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে নারীসহ তিন শিক্ষক গুরুতর আহত হয়, গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনের মুখপাত্র সাইদুল ইসলাম শামীমসহ অন্তত ৭ জনকে। এর কিছুক্ষণ পর সকাল ১১ টার দিকে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আহতদের দেখতে যাওয়া আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ।
আন্দোলনে সংহতি জানানো ২৪’ এর গণ অভ্যুত্থানে কক্সবাজারের ছাত্র প্রতিনিধি ও এনসিপি নেত্রী জিনিয়া শারমিন রিয়াসহ অন্তত ১৩ জনকে দ্বিতীয় দফায় পুলিশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষক প্রতিনিধি, সাইদুল ইসলাম শামীম (২৩), সুজন রানা (২৬), মিনুয়ারা বেগম (২০), সাজিয়া বেগম (২৪), আসমাউল হোসনা (২৬), আবু ইমরান (৩০), তারেকুর রহমকন (৩০), সাকিব (২৬), দেলুয়ার হোসেন নওশাদ (৩০) ও ঊর্মী আক্তার (২৫) কে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে গ্রেফতারের সময় জিনিয়াকে পুলিশের উদ্দেশে বলতে শোনা যায় – ‘আমি অধিকারের জন্য কথা বলছি, আমি কি ছাত্রলীগ?’ আটকের খবর ছড়িয়ে পড়লে উখিয়া থানা ফটকে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে কমপক্ষে ৫ শতাধিক আন্দোলনকারী।
‘ভূয়া,ভূয়া’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে গ্রেফতারকৃতদের অনতিবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়ে থানা ঘেরাও করে রাখা হয় প্রায় ৮ ঘন্টা ধরে। পাশাপাশি থানার ওসি আরিফ হোছাইনের অপসারন দাবি করে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে আন্দোলনকারীরা।
দুপুর দেড়টার দিকে থানায় প্রবেশ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব এস এম সুজা উদ্দিনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
থানায় প্রবেশের আগে জিনিয়াসহ তার দুই সহযোদ্ধাকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে এস এম সুজা উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সুষ্ঠু সমাধানের জন্য এসেছি৷ উখিয়া কোনো আলাদা দেশ নয় যে এখানে আন্দোলন করা যাবেনা। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং সম্মানের সহিত তাদের ছেড়ে দিতে হবে।’
এনসিপি নেতৃবৃন্দের উপস্থিতির পর আলোচনায় অংশ নিতে থানায় প্রবেশ করেন উপজেলা বিএনপির আহবায়ক সরোয়ার জাহান চৌধুরীসহ বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। আলোচনা চলাকালীন সময় বিকেল পৌনে তিনটার দিকে থানা সড়কে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে দিকবেদিক ছুটা ছুটি করতে গিয়ে ৩/৪ জন আহত হন।
বিকেল ৫টায় আলোচনা শেষে লিখিত সমঝোতার মাধ্যমে এনসিপি নেত্রী জিনিয়া সহ ২৮ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষকেরা বলেন, ইউনিসেফের লার্ণিং সেন্টারগুলো পরিচালনায় তহবিল-সংকটের অজুহাতে স্থানীয়দের চাকরিচ্যুত করেছে। এর ফলে অনেকের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
গত জুলাই মাসে প্রায় দেড় হাজার স্থানীয় শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষকরা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনে নামেন। চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের দাবি, প্রশাসন সমাধানের আশ্বাস দিলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে তারা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
একই দাবিতে গত সোমবার সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তারা কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক অবরোধ করেন। এসময় উভয় পাশে শত শত গাড়ি গ্রেফতারের পড়ে, যাত্রী ও চালকেরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ৪ লাখের মতো। এসব আশ্রয়শিবিরে প্রায় চার হাজার শিক্ষাকেন্দ্রে আড়াই লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরকে পাঠদান করা হয়।
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আশ্রয়শিবিরে সাড়ে চার হাজারের অধিক শিক্ষাকেন্দ্র চালু আছে। এসব ‘লার্নিং সেন্টারে’ প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার শিশু পড়াশোনা করে।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া কর্মকর্তা) মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক রয়েছে। আমরা সেখানে কয়েকজনকে হেফাজতে নিয়েছিলাম। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে লিখিত মুচলেখা নিয়ে বিকাল পাঁচটায় ছেড়ে দেওয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার চাকরিচ্যুতদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছিল বলে জানান তিনি।’