মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:৫৪ অপরাহ্ন

ইরানের স্যাটেলাইট কার্যক্রম: দুই দশকের মহাকাশ অভিযাত্রা ও ভবিষ্যৎ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • প্রকাশের সময়ঃ মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫
  • ৩ প্রদর্শন করেছেন

দুই দশক আগেও যা ছিল কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আজ তা হয়ে উঠেছে বাস্তবতা—ইরান এখন মহাকাশ অভিযাত্রায় এক দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী শক্তি। এখন পর্যন্ত দেশটি অন্তত ২৫টি স্যাটেলাইট সফলভাবে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে, যার প্রতিটি ছিল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সাক্ষর ও বিশেষ উদ্দেশ্যনির্ভর। আন্তর্জাতিক অবরোধ ও প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশটি মহাকাশ গবেষণায় যেভাবে এগিয়েছে, তা শুধু জাতীয় আত্মনির্ভরতার প্রতীক নয়, বরং বৈশ্বিক মহাকাশ প্রতিযোগিতায় একটি বিকল্প শক্তি হিসেবেও ইরানকে প্রতিষ্ঠা করেছে।

নাহিদ-২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং প্রযুক্তিগত অর্জন

গত ২৫ জুলাই ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত ‘নাহিদ-২’ স্যাটেলাইট রাশিয়ার ভস্তোচনি কসমোড্রোম ঘাঁটি থেকে ‘সোয়ুজ’ রকেটের মাধ্যমে সফলভাবে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এটি ইরানের গবেষণা ও টেলিকমিউনিকেশন খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

নাহিদ-২ স্যাটেলাইট

ইরান স্পেস রিসার্চ সেন্টার ও ইরানিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই স্যাটেলাইটটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো— এটি কক্ষপথে পাঁচ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে এবং নিজের কক্ষপথের উচ্চতা ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঠিক রাখতে পারবে। এই উদ্দেশ্যে এতে যুক্ত করা হয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয়ভাবে নির্মিত প্রপালশন সিস্টেম।

‘নাহিদ-২’ স্যাটেলাইটে রয়েছে- হট গ্যাস থ্রাস্টার, কম্পোজিট ফুয়েল ট্যাংক, হাই-প্রেশার ভালভ এবং হাই-প্রিসিশন নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি। এছাড়াও এতে ব্যবহৃত হয়েছে- ইরানের তৈরি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, পলিমারভিত্তিক তাপ নিরোধক আবরণ এবং স্পেস-গ্রেড আঠা, যা স্যাটেলাইটের ইঞ্জিন ও বাইরের আবরণে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

নাহিদ-১ ছিল ইরানের প্রথম টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট, যা শুধুমাত্র একমুখী মেসেজিং-এর ক্ষমতা রাখত। কিন্তু নাহিদ-২ দ্বিমুখী যোগাযোগ, উন্নত নেভিগেশন  ও দ্রুত তথ্য সংযোগের মাধ্যমে এক বিশাল অগ্রগতি। এটি ভবিষ্যতের উচ্চ কক্ষপথ স্যাটেলাইট প্রকল্পগুলোর জন্য একটি পরীক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করবে।

নাহিদ-২ একটি হালকা ওজনের (প্রায় ১১০ কেজি) স্যাটেলাইট, যা পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথ (৫০০ কিমি উচ্চতা, ৫৫ ডিগ্রি ইনক্লিনেশন) ঘিরে আবর্তিত হয়। এই ধরনের কক্ষপথ তাৎক্ষণিক যোগাযোগের জন্য আদর্শ, কারণ এখানে সিগন্যাল দ্রুত পৌঁছে যায়।

প্রাথমিক তথ্য পাঠাচ্ছে নাহিদ-২

নাহিদ-২ উপগ্রহ থেকে প্রাথমিক টেলিমেট্রি সংকেত গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেনইরানি মহাকাশ সংস্থার (আইএসএ) প্রধান হোসেইন সালারিয়েহ। তিনি বলেছেন, সংকেতগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, কৃত্রিম এই উপগ্রহটি বর্তমানে অক্ষত রয়েছে এবং তার নির্ধারিত কক্ষপথে প্রত্যাশার আলোকেই কাজ করছে।

ইরানের প্রেসটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সালারিয়েহ বলেছেন, ইরানি বিজ্ঞানীদের তৈরি এই কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে সফলভাবে স্থাপিত হয়েছে এবং ইরান আরও উন্নত প্রজন্মের কৃত্রিম উপগ্রহ নাহিদ-৩ তৈরির কাজ করছে বলে তিনি

স্যাটেলাইট উদ্যোগ: দুই দশকের পথচলা

গত দুই দশকে ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে গড়া বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট সফলভাবে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে। এর মাধ্যমে ইরান আন্তর্জাতিক মহাকাশ প্রতিযোগিতায় নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে। ইরানের কিছু উল্লেখযোগ্য ও কার্যকর স্যাটেলাইটের বিবরণ তুলে ধরা হলো:

সিনা-১ (২০০৫): ইরানের প্রথম স্যাটেলাইট, যা রাশিয়ার সহায়তায় উৎক্ষেপিত হয়। এটি ছিল একটি পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট।

ওমিদ (২০০৯): প্রথম সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট, যা ‘সাফির’ রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয়।

রাসাদ-১ (২০১১): ইমেজিং স্যাটেলাইট, যা ৩৫ দিন কক্ষপথে থেকে পৃথিবীর ছবি পাঠিয়েছিল।

ফজর (২০১৫): ইনফ্রারেড সেন্সর ও উন্নত ক্যামেরা সংবলিত ভূ-পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট, নিরাপত্তা ও বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়।

খৈয়াম (২০২২): উচ্চ রেজুলিউশনের ছবি তুলতে সক্ষম উপগ্রহ, যা পরিবেশ ও কৃষি খাতে ব্যবহারযোগ্য তথ্য দেয়।

পার্স-১ (২০২৪): ভূগর্ভস্থ সম্পদ অনুসন্ধান ও দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ সক্ষম গবেষণা স্যাটেলাইট।

কাওসার ও হুদহুদ (২০২৪): বেসরকারি উদ্যোগে উৎক্ষেপিত স্যাটেলাইট, কৃষি, পরিবেশ ও যোগাযোগ খাতে ব্যবহৃত হয়।

২০২৫-এর নতুন পরিকল্পনা ও উৎক্ষেপণ সূচি

ইরানি মহাকাশ সংস্থা ঘোষণা করেছে, ২০২৫ সালে আরও কয়েকটি নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে। যেমন জাফর ও পায়া, পার্স-১ (দ্বিতীয়) ও পার্স-২ (সম্ভাব্য), কাওসার (দ্বিতীয় প্রোটাটাইপ) এবং বেসরকারি খাতের একাধিক স্যাটেলাইট। ২০২৪ সালে উৎক্ষেপণ হওয়া সামান-১ অরবিটাল ট্রান্সফার ব্লকের একটি উন্নত সংস্করণও ২০২৫ সালে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মাধ্যমে ইরান উচ্চ-কক্ষপথে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

উৎক্ষেপণক্ষমতায় বিশ্বসেরাদের কাতারে ইরান

২০০৯ সালে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত ‘সাফির’ উৎক্ষেপণযানের মাধ্যমে ‘ওমিদ’ স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়ে ইরান বিশ্বের নবম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট ও উৎক্ষেপণযান ব্যবহারে সক্ষমতার স্বীকৃতি অর্জন করে।

বর্তমানে বিশ্বে মাত্র ১১টি দেশ রয়েছে যারা নিজস্ব নির্মিত উৎক্ষেপণযান ব্যবহার করে কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠাতে সক্ষম—ইরান তাদের অন্যতম। ইরান ইতোমধ্যে ছয়টি নিজস্ব উৎক্ষেপণযোগ্য স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা এবং টেকনিক্যাল স্বনির্ভরতার ভিত্তিতে অনেক পরিসংখ্যানে ইরানকে ৯ম অবস্থানে গণ্য করা হয়।

আরেকটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মাত্র ৬–৭টি দেশ রয়েছে যারা একাধিকবার সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। অনেক দেশ—যেমন জার্মানি, ব্রাজিল বা সংযুক্ত আরব আমিরাত—যদিও স্যাটেলাইট নির্মাণে সক্ষম, তবে তারা উৎক্ষেপণের জন্য অন্য দেশের রকেট ব্যবহার করে, ফলে তারা এই তালিকায় পড়ে না।

২০২০ সালে ‘সাফির’ উৎক্ষেপণযানের সাহায্যে ‘জাফর’ স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায় ইরান

ইরানের স্যাটেলাইট নিয়ে বিতর্ক

ইরান তার স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে টেলিযোগাযোগ, কৃষি, পরিবেশ, খনিজসম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো বেসামরিক খাতে ব্যবহার করার কথা বললেও, পশ্চিমা বিশ্বে এর সামরিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) পরিচালিত কয়েকটি উৎক্ষেপণের পর এই বিতর্ক আরও জোরালো হয়।

নূর-১ (২০২০): প্রথম সামরিক স্যাটেলাইট, ‘কাসেদ’ রকেট দিয়ে উৎক্ষেপিত। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েল অভিযোগ তোলে, এটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির আড়ালে পরিচালিত হতে পারে এবং জাতিসংঘ প্রস্তাব ২২৩১ লঙ্ঘন করে।

নূর-২ (২০২২) ও নূর-৩ (২০২৩): যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সামরিক স্যাটেলাইট, যা ৫০০ কিমি কক্ষপথে স্থাপিত হয়। উভয়ই আইআরজিসি’র সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত।

যুক্তরাষ্ট্র বারবার দাবি করেছে, ইরানের মহাকাশ কর্মসূচির অন্তরালে রয়েছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম বাহন তৈরি সম্ভব। ফ্রান্স ও জার্মানি উদ্বেগ জানিয়েছে, ইরানের উৎক্ষেপণ প্রযুক্তি জাতিসংঘের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাব  লঙ্ঘন করছে। ইসরায়েল আরও একধাপ এগিয়ে একে সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি বলে আখ্যায়িত করেছে।

তবে ইরান বরাবরই এ অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তাদের দাবি, ইরানের মহাকাশ কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ ও প্রতিরক্ষামূলক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাব তারা লঙ্ঘন করেনি, বরং মহাকাশ গবেষণা ও উৎক্ষেপণ কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার।

মহাকাশে শিল্পায়নের পথে ইরান

২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ইরান পরীক্ষামূলকভাবে ‘শহীদ সোলাইমানি’ স্যাটেলাইট কনস্টেলেশন উৎক্ষেপণ শুরু করবে। এই কনস্টেলেশনে প্রায় ২০টি স্যাটেলাইট থাকবে, যার মূল উৎক্ষেপণ ২০২৬ সালে হবে। এই প্রকল্পে ইরানের বেসরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ রয়েছে এবং এটি ইরানের মহাকাশ কর্মসূচিকে শিল্প পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

চাঁদ জয়ের প্রত্যয়

ইরানের মহাকাশ কার্যক্রম এখন আর শুধু পৃথিবীকেন্দ্রিক পর্যবেক্ষণ বা কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপনেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দেশটি ধীরে ধীরে আরও উচ্চাভিলাষী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অভিযাত্রার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইরান স্পেস এজেন্সি ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে—তারা ২০৩১ সালের মধ্যে চাঁদের উদ্দেশ্যে একটি মানবনিয়ন্ত্রিত রোবটিক মিশন পাঠাতে চায়, যা দেশটির মহাকাশ ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

এই লক্ষ্যে ইরান একদিকে যেমন নিজস্ব উৎক্ষেপণযান ‘জুলজানাহ’, ‘কাসেদ’, ‘সিমোর্গ’ এবং ‘সাফির’-এর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য সহযোগিতার দ্বারও খোলা রেখেছে। এছাড়া, ইরান এমন এক স্বাধীন ন্যাভিগেশন ব্যবস্থা গড়ার পরিকল্পনা করছে, যাতে পশ্চিমা জিপিএস নির্ভরতা হ্রাস পায়।

দেশটির সর্বোচ্চ নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনি মহাকাশকে ‘কৌশলগত প্রান্তসীমা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এর দখলে দেশীয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য বহুবার বিজ্ঞানীদের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর কৌশলগত দিকনির্দেশনায় ইরান আজ শুধু একটি প্রযুক্তি-উন্নয়নশীল দেশ নয়, বরং মহাকাশ প্রতিযোগিতায় আত্মবিশ্বাসী এক উদীয়মান শক্তিতে পরিণত হয়েছে—যা আগামী দশকে মহাকাশ শিল্পে দেশটির অবস্থান আরও মজবুত করে তুলতে পারে।

লেখক: রেডিও তেহরান বাংলা’র সিনিয়র সাংবাদিক।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ