ভারতের কেরালা রাজ্যে বসবাসরত দুই বোন বছরের পর বছর নাগরিকত্বহীন অবস্থায় আটকে আছেন। পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ত্যাগের প্রমাণ না থাকায় তারা এখনো কোনো দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।
বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে জিও নিউজ।
বিবিসিকে উদ্ধৃত করে দ্য নিউজ জানিয়েছে, বোন দুজন আদালতকে বলেন, ২০১৭ সালে তারা নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানের হাইকমিশনে পাসপোর্ট জমা দেন। কিন্তু বয়স ২১ বছরের কম থাকায়—যা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব ত্যাগের ন্যূনতম শর্ত—তাদের সনদ দেওয়া হয়নি।
২১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর আবারও হাইকমিশনের দ্বারস্থ হলেও এবারও তারা প্রত্যাখ্যাত হন। তবে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তাদের মা রাশিদা বানু জানান, তিনিও ও তার ছেলে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, কিন্তু তার দুই মেয়ে বহু বছর ধরে অচলাবস্থায় আছেন। ফলে তারা পাসপোর্টের আবেদন পর্যন্ত করতে পারছেন না।
২০১৮ সালে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে একটি সনদ দেওয়া হয়েছিল, যেখানে বলা হয় মেয়েরা পাসপোর্ট জমা দিয়েছে এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে পাকিস্তানের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এটি গ্রহণ করেনি, বরং আনুষ্ঠানিক নাগরিকত্ব ত্যাগের সনদই চেয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে তারা আদালতে যান। গত বছর কেরালা হাইকোর্টের একক বেঞ্চ রায়ে বলেছিল, আবেদনকারীরা এমন একটি নথি পেশ করতে পারবে না—তাদের ‘অসম্ভব কাজ’ করতে বলা যায় না। তাই ভারত সরকারকে নাগরিকত্ব দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারক। তবে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট একই আদালতের দুই সদস্যের বেঞ্চ সেই রায় বাতিল করে দেন।
রায়ে বলা হয়, ‘ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার একমাত্র কর্তৃত্ব ভারত সরকারের। অন্য কোনো রাষ্ট্রের দাবি যাতে না থাকে, সেই স্পষ্টতার জন্যই আনুষ্ঠানিক নাগরিকত্ব ত্যাগের প্রক্রিয়া অপরিহার্য।’
এখন তাদের সামনে বিকল্প পথ কেবল উচ্চ আদালতে আপিল করা।
আইনজীবী এম সাসিন্দ্রনের মতে, ‘২০১৭ সালে তারা নাবালক থাকায় সনদ পায়নি। এখন প্রাপ্তবয়স্ক হলেও পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে সনদ আনার কোনো উপায় নেই, কারণ তাদের হাতে আর কোনো পাসপোর্ট নেই। ফলে তারা কার্যত আটকে গেছে।’
পরিবারের ইতিহাসও জটিল। দুই বোনের বাবা মোহাম্মদ মারুফ জন্মেছিলেন কেরালায়, কিন্তু শিশু বয়সে দাদির সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যান। মা রাশিদা বানুর বাবা-মাও মূলত ভারতীয় ছিলেন, কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকে পড়েন এবং পরে সেখানেই নাগরিকত্ব নেন।
২০০৮ সালে রাশিদা বানু স্বামী ও চার সন্তানকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ভিসায় ভারতে আসেন। তবে স্বামী পাকিস্তানে ফিরে যান। তিনি ও তার ছেলে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেলেও দুই মেয়ে আজও নাগরিকত্বহীন।
এর ফলে তাদের নিত্যজীবনে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মোবাইল ফোন সংযোগ বা সন্তানদের স্কুলে ভর্তি—সব জায়গায়ই সমস্যায় পড়তে হয়। যদিও আধার কার্ড তারা পেয়েছেন, কিন্তু এটি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়।
পাসপোর্ট না থাকায় আরও বড় সংকটে পড়েছেন তারা। একজনের স্বামী উপসাগরীয় দেশে চাকরি করলেও স্ত্রীর বিদেশযাত্রার সুযোগ না থাকায় তাকে চাকরি ছেড়ে ভারতে ফিরতে হয়েছে। অপরজনের সন্তান চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া দরকার, কিন্তু সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।
আইন অনুযায়ী, পাকিস্তানে ২১ বছরের নিচে কেউ সরাসরি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে পারে না, তবে বাবার আবেদনে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যেহেতু তা হয়নি, তাই এখন তারা কার্যত আইনের ফাঁদে আটকে পড়েছে।
রাশিদা বানুর ভাষায়, ‘আমরা পাকিস্তানের পরিচয়পত্র দেখিয়ে সামাজিকভাবে হেনস্তা হয়েছি, কিন্তু অন্তত একটি পরিচয়পত্র ছিল। আমার মেয়েদের হাতে সেটুকুও নেই। তারা এখন সত্যিই দিশেহারা।’