দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত, হস্তক্ষেপ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ আফগানিস্তান এখনো আঞ্চলিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর ওঠানামার মধ্যেও পাকিস্তান তার নিজস্ব অবস্থান ও নীতিতে অবিচল রয়েছে—যা বিশ্লেষকদের মতে ‘কৌশলগত ধৈর্য’- এর প্রতিফলন।
পাকিস্তানের আফগানিস্তাননীতি মূলত নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সমন্বয়ে গঠিত। দেশটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, পশ্চিম সীমান্তে অস্থিতিশীলতা সরাসরি প্রভাব ফেলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অবস্থানে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) এ নিয়ে এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যম জিও নিউজ।
দীর্ঘমেয়াদি সম্পৃক্ততা ও ক্ষয়ক্ষতি
৯/১১–এর পর বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সম্মুখসারিতে থাকা পাকিস্তান প্রায় ৮০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ও ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। আফগানিস্তানের সংঘাত থেকে সৃষ্ট তিন মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীও এখনো দেশটিতে অবস্থান করছে।
ইসলামাবাদের কর্মকর্তারা দাবি করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তুলনায় পাকিস্তানই সবচেয়ে বড় মূল্য পরিশোধ করেছে, অথচ বৈশ্বিক বিশ্লেষণে সেই ভূমিকা প্রায়ই অবমূল্যায়িত হয়।
সংযম ও কূটনৈতিক ভারসাম্য
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফগান তালেবান সরকার গঠনের পর পাকিস্তানের সামনে একদিকে স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে টিটিপি–এর (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) হামলা ও সীমান্ত উত্তেজনা নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তবুও ইসলামাবাদ সংযমের পথ বেছে নিয়েছে—একতরফা সামরিক পদক্ষেপের বদলে সংলাপ ও প্রতিরোধের সমন্বিত কৌশল নিয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি পাকিস্তানের ‘প্রাপ্তবয়স্ক রাষ্ট্রনীতি’ এবং ‘ধৈর্যের কূটনীতি’-র প্রকাশ।
নিরাপত্তা থেকে অর্থনীতিতে দৃষ্টিপরিবর্তন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান আফগান নীতি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। এখন দেশটি শুধু নিরাপত্তা–নির্ভর নয়, বরং বাণিজ্য, যোগাযোগ ও আঞ্চলিক একীভবনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
সিএএসএ-১০০০ জ্বালানি প্রকল্প ও চীন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)–এর মতো উদ্যোগ ইসলামাবাদের লক্ষ্য স্পষ্ট করেছে—আফগানিস্তানকে ‘বাফার জোন’ নয়, বরং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সংযোগসেতু হিসেবে গড়ে তোলা।
ভারতের ভূমিকা নিয়ে সতর্কতা
পাকিস্তান সরকার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা অভিযোগ করছেন, আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব ও টিটিপি–এর প্রতি সম্ভাব্য সমর্থন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে জটিল করছে। ভারত সম্প্রতি আফগান তালেবানের সঙ্গে সীমিত যোগাযোগ বাড়িয়েছে, যা ইসলামাবাদের মতে, পাকিস্তানের প্রভাবক্ষেত্র দুর্বল করার কৌশল হতে পারে।
কৌশলগত ধৈর্যের প্রতিফলন
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানের ‘কৌশলগত ধৈর্য’ কোনো দুর্বলতার প্রকাশ নয়; বরং এটি দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার প্রতিফলন। দেশটি বুঝতে পেরেছে যে আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি কেবল সামরিক শক্তিতে নয়, বরং আঞ্চলিক ঐকমত্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব।
‘পাকিস্তান এখন দখল নয়, প্রভাবের মাধ্যমে ক্ষমতা সংজ্ঞায়িত করতে চায়,’ বলেন এক দক্ষিণ এশীয় পর্যবেক্ষক।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তি আফগানিস্তান থেকে সরে গেছে, সেখানে পাকিস্তান এখনো ভূগোল, নিরাপত্তা ও মানবিক বাস্তবতার ভার বহন করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধারাবাহিক সম্পৃক্ততাই ইসলামাবাদকে একটি পরিণত আঞ্চলিক অংশীদার হিসেবে তুলে ধরেছে।
পাকিস্তানের বর্তমান আফগান নীতি তাই মূলত ধৈর্য, সংযম ও বাস্তবতার সমন্বয়। দশকের পর দশক ত্যাগ ও অভিজ্ঞতা থেকে শেখা এই নীতিতে ইসলামাবাদ বিশ্বাস করে—দক্ষিণ এশিয়ার স্থায়ী শক্তি অস্ত্রে নয়, বরং শান্তিতেই নিহিত।