শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩২ অপরাহ্ন

হাসিনার রায় বিলম্বিত করার নতুন কূটকৌশল, নভেম্বরে রায় অনিশ্চিত

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫
  • ২১ প্রদর্শন করেছেন

ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও ছেলে জয় এবং মেয়ে পুতুলসহ শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে রাজউকের প্লট দুর্নীতির ৬ মামলার বিচারকাজ নভেম্বরে শেষ হচ্ছে না। এতদিন ধারণা করা হচ্ছিল নভেম্বরের মধ্যে মামলার বিচার নিষ্পত্তি হবে। এমনকি রায়ও হতে পারে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুদক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ৬টি মামলার রায় অক্টোবরের শেষ নাগাদ বা নভেম্বরের মাঝে হবে বলে আশা করি। দুদকের প্রসিকিউশন টিমও মামলার শুনানি শেষের দিকে নিয়ে এসেছিল। আসামিদের অনুপস্থিতিতেই চলছিল মামলাগুলোর বিচার শুনানি। সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে এসে ঘটল এক অভিনব ঘটনা। হঠাৎ করেই মামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক এক আসামি রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গত ২৯ অক্টোবর (বুধবার) আত্মসমর্পণ করে বসেন।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ মামলায় যেহেতু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পরিবারের সবাই আসামি এবং আগামী নির্বাচনের আগে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই তাদের কূটচালের অংশ হিসাবে ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছেন রাজউকের বরখাস্ত হওয়া ওই কর্মকর্তা। তারই আত্মসমর্পণের ফলে বিচার বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আদালত-সংশ্লিষ্টদের দাবি, আসামিরা বিচার বিলম্বিত করার জন্য এক এক করে আত্মসমর্পণ করে সাক্ষী ‘রিকল’ করার কৌশল অবলম্বন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে মামলার বিচার শেষ হতে কত সময় লাগবে তা বলা মুশকিল।

বুধবার দুদকের ৬ মামলার মধ্যে এক মামলার আসামি রাজউকের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আত্মসমর্পণ করলে জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এই আসামির আত্মসমর্পণের সূত্র ধরে মামলার বিচার শুনানি ত্বরান্বিত করার বিষয়ে যে তাগিদ ছিল তা পেছানোর আশঙ্কা করছে প্রসিকিউশন বিভাগ। কারণ এতদিন শেখ হাসিনাসহ ২৩ জন আসামি পলাতক থাকায় সাক্ষীকে জেরা করা হয়নি। তবে আসামি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আদালতে আত্মসমর্পণ করায় তার পক্ষে একজন আইনজীবী শাহীনুর রহমান বুধবার সাক্ষীদের জেরা করেন।

এ বিষয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি যুগান্তরকে বলেন, দুদকের মামলা হলো দালিলিক সাক্ষী। এগুলো তো অন্যান্য মামলার মতো না। সে ক্ষেত্রে উনি (খুরশীদ) আত্মসমর্পণ করছেন, উনার বিষয়ে যে সাক্ষী বলেছেন, উনি শুধু তাকে জেরা করবেন। উনার সম্পর্কে শুধু আইও বলেছেন। আইও তো ওইদিন উপস্থিত ছিলেনই। অন্য সাক্ষীরাও ছিলেন। উনারা তো অনেক সাক্ষীকে ‘ডিক্লাইন’ করেছেন। আসামি আত্মসমর্পণ করে যদি সাক্ষী রিকল করে, এটা তার আইনগত অধিকার। তার আইনগত অধিকারে তো আদালত অথবা দুদকের বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর যদি বিচার বিলম্ব করতে চায়, তাহলেও বিচার চলবে। সেক্ষেত্রে একটু বিলম্ব হতে পারে। কিন্তু বিচার হবেই।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ ধারা অনুযায়ী, আদালত যে কোনো পর্যায়ে ন্যায়ের স্বার্থে সাক্ষীকে পুনরায় হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। এই বিধান অনুযায়ী বিচার চলাকালে যদি কোনো সাক্ষ্যের অস্পষ্টতা, নতুন তথ্য বা প্রমাণ উত্থাপিত হয়, তবে আদালত নিজে অথবা পক্ষভুক্ত যে কেউ আবেদন করে সাক্ষী রিকল করতে পারে। আদালতের বিবেচনায় যদি মনে হয়, পুনঃজিজ্ঞাসাবাদ করলে সত্য উদ্ঘাটন সহজ হবে, তবে আদালত সাক্ষী রিকলের অনুমতি দিতে পারেন।

আইনসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যদি কোনো মামলায় অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোনো আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং আদালত সেই আত্মসমর্পণ গ্রহণ করে নেন, তখন আসামির আইনগত অধিকার থাকে তার বিরুদ্ধে দেওয়া সাক্ষ্যগুলোকে রিকল করার। এই রিকলের প্রক্রিয়াটি এভিডেন্স অ্যাক্ট সেকশন ১৩৮ এবং সিআরপিসির ৫৪০ ধারা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। প্রত্যেক আসামিও যদি আত্মসমর্পণ করে, তাহলে সাক্ষী রিকল করার সুযোগে আইনে আছে। বিচার বিলম্বিত করার জন্য আসামিরা আত্মসমর্পণ করে সাক্ষী রিকল করার কৌশল অবলম্বন করার পথ অনুসরণ করছে কিনা তা ভাবিয়ে তুলেছে প্রসিকিউশনকে।

সাক্ষী রিকল করার প্রসঙ্গে আসামি মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের আইনজীবী এডভোকেট শাহীনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। কারণ আমি তো ফার্স্ট আদালতে উপস্থিত ছিলাম। আমি রেকর্ড দেখার সুযোগ পাইনি। কোর্ট থেকে পারমিশন নিয়ে রেকর্ডটা দেখব। তারপর যদি আমি মনে করি যে, কোনো সাক্ষীকে রিকল করার প্রয়োজন আছে-তবেই আমি রিকল করব। না হলে করব না।

গত ৩১ জুলাই পৃথক ৬ মামলায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের সাত সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার দুটি বিশেষ জজ আদালত। এর মধ্যে তিন মামলায় গত ১১ আগস্ট প্রথম দিনে তিন মামলার তিন বাদী, ২৬ আগস্ট পৃথক তিন মামলায় ১৭ জন, তৃতীয় দিন ২ সেপ্টেম্বর ১৮ জন, ১৭ সেপ্টেম্বর ১০ জন, ৩০ সেপ্টেম্বর ৯ জন এবং ১৫ অক্টোবর ১২ জন সাক্ষ্য দেন।

এর মধ্যে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে ৩ মামলায় শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ১১ আগস্ট। অপরদিকে ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ রবিউল আলমের আদালতে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকদের বিরুদ্ধে আরও ৩ মামলার বিচার শুনানি শুরু হয় ১৩ আগস্ট। সব মামলাতেই সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

গত বছরের অক্টোবরে দৈনিক যুগান্তর ‘শেখ হাসিনার পরিবারের ৬ সদস্যের নামে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম’ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। পরে এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ কমিটিকে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪) রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগও তদন্ত করতে বলা হয়।

গেল বছরের ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এরপর ৬টি মামলা হয়। তদন্ত শেষে ১০ মার্চ ৬ মামলায় শেখ হাসিনা পরিবারের ৭ জনসহ ২৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন করা হয়। ৩১ জুলাই ৬ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত ও ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালত।

এসব মামলার আসামিরা হলেন-শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও অপর মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক।

শেখ পরিবার ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন-জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদ, সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নুরুল ইসলাম, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলাম, উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান, হাবিবুর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ