মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০২:০৭ পূর্বাহ্ন

ড্যাপ সংশোধন: বাদ পড়ছে গাজীপুর, ৫ তলা ভবন হবে ১১

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫
  • ১৫ প্রদর্শন করেছেন

ঢাকার উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) রাজধানীকে পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগরীতে রূপ দিতে ২০২২ সালে প্রকাশ করে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। এতে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়নসহ নাগরিক সুবিধার নানা মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে প্রকাশের পর থেকেই এ পরিকল্পনার বিভিন্ন ধারা নিয়ে মতবিরোধ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি সরকার ড্যাপের সংশোধিত প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে।

সংশোধিত ড্যাপে রাজধানীকে আগের ২৭৫টি ব্লকের পরিবর্তে ৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। গাজীপুরের অংশ বাদ দিয়ে নতুন পরিকল্পনায় ঢাকার আয়তন নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার। এতে ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, রাজধানীর ব্লক সংখ্যা ৬৮-এ নামিয়ে আনার মূল লক্ষ্য হলো পরিকল্পনাকে আরও সরল, বাস্তবায়নযোগ্য ও আধুনিক করা। একই সঙ্গে নগর উন্নয়নের প্রয়োজন বিবেচনায় কিছু এলাকায় ভবনের উচ্চতা ও জনঘনত্ব বৃদ্ধির সুযোগ রেখে একটি কার্যকর ও টেকসই নগর কাঠামো গড়ে তোলাই এর উদ্দেশ্য।

ড্যাপ সংশোধনের ফলে রাজউক এলাকার প্রায় সব জায়গাতেই ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। সংশোধিত ড্যাপ এবং খসড়া ‘ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা–২০২৫’ অনুযায়ী, বহু এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, আগে যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণের অনুমতি মিলত, সেখানে এখন ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যাবে। নতুন বিধিমালায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যোগ করা হয়েছে। যেমন- কোনো প্লটে যত বেশি খোলা জায়গা রাখা হবে, ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেই অনুপাতে অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হবে।

২০২২ সালে গেজেট আকারে প্রকাশের পর ড্যাপে একবার সংশোধন আনা হলেও, আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা ঢাকায় ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ অক্টোবর সরকার রাজধানীকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রণীত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)-এর সংশোধন প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়। এই অনুমোদনের ভিত্তিতে শিগগিরই সংশোধিত ড্যাপ (২০২২–২০৩৫) গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে।

ওই দিন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রকাশিত ড্যাপে জনঘনত্ব ও নাগরিক সুবিধার সমন্বয় বজায় রাখতে ভবনের উচ্চতা সীমিত রাখা হয়েছিল। তবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে আবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের তীব্র বিরোধিতার কারণে ড্যাপ সংশোধন শুরু হয়। পূর্বে অপ্রশস্ত রাস্তায় ৮ থেকে ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি থাকলেও ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়, এবং সেখানে সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ তলা ভবন নির্মাণের বিধান রাখা হয়।

এই সিদ্ধান্তে জমির মালিক, ডেভেলপার ও হাউজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা বাণিজ্যিকভাবে ভবন নির্মাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিলে রাজধানীতে ফ্ল্যাটের দাম ও বাড়িভাড়া বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় আবাসন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা বারবার ড্যাপ সংশোধনের জন্য চাপ দিতে থাকেন।

সর্বশেষ সংশোধনী আনার আগে, ড্যাপের খসড়ায় ১২ থেকে ১৬ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ধরা হয়েছিল ১.৭৫। এর অর্থ হলো— এমন প্রশস্ত রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠার প্লটে পার্কিংসহ সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা যেত।

সম্প্রতি সরকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)-এর সংশোধনী প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। নতুন এই সংশোধনীতে ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় ভবনের উচ্চতা সীমা বাড়ানো, মুখ্য ও সাধারণ জলস্রোত একীভূত করে বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ঘোষণা এবং ব্লকভিত্তিক উন্নয়নে অন্তত ৫০ শতাংশ এলাকা খেলার মাঠ ও পার্কের জন্য সংরক্ষণ করার মতো বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে।

ড্যাপের এই নতুন সংশোধনীর ফলে এখন রাজউক এলাকার প্রায় সব জায়গাতেই ভবনের উচ্চতা বাড়ছে। সংশোধিত ড্যাপ এবং ‘খসড়া ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা– ২০২৫’ অনুযায়ী— বহু এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগে যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল, এখন সেখানে ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যাবে।

রাজউকের নতুন বিধিমালায় যুক্ত হয়েছে একটি বিশেষ প্রণোদনা ব্যবস্থা। এর আওতায় কোনো প্লটে যত বেশি খোলা জায়গা রাখা হবে, ভবনের উচ্চতা তত বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে। অর্থাৎ, যদি কোনো এলাকায় এফএআরের মান ২.৫ হয়, তাহলে ন্যূনতম ফাঁকা জায়গা রেখে ৪ থেকে ৫ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যাবে। তবে জমির মালিক যদি আরও বেশি খোলা জায়গা রাখেন, তাহলে একই জমিতে ৭ থেকে ৮ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাবে।

যেসব এলাকায় এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে—শেওড়াপাড়ায় ২ থেকে ৩, কড়াইলে ২ পর্যন্ত, মহাখালীতে ২.২ থেকে ৩.৩, মোহাম্মদপুরে ২.৭ থেকে ৩.৪, পুরান ঢাকায় ২.৬ থেকে ৩.৩, খিলগাঁওয়ে ২ থেকে ৩.৪, মিরপুরে ২.৮ থেকে ৩.৪, দক্ষিণখানে ২ থেকে ৩.১, টঙ্গীতে ২.৪ থেকে ৩.২, রূপগঞ্জে ২ থেকে ৩.২, সাভারে ২ থেকে ৩.৪, মিরপুর ডিওএইচএসে ২.৫ থেকে ৪.৮ এবং খিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় ২ থেকে বাড়িয়ে ৪.৪ করা হয়েছে।

এছাড়া বারিধারা, মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, ডেমরা, বসুন্ধরা, কচুক্ষেত, উত্তরা, লালমাটিয়া, মগবাজারসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যমান এফএআরের তুলনায় সর্বোচ্চ ১.৫ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্লকভিত্তিক উন্নয়নে একাধিক প্লট একীভূত করা হলে নির্ধারিত এফএআরের ওপর অতিরিক্ত ০.২৫ থেকে ০.৭৫ পর্যন্ত বোনাস সুবিধাও দেওয়া হবে।

রাজউক জানিয়েছে, নতুন বিধানে কোনো প্লট বা জমির মালিক যত বেশি খোলা জায়গা ছেড়ে দেবেন, তার প্লটে ভবনের উচ্চতা তত বেশি করার অনুমতি মিলবে। ফলে ভবনের উচ্চতা বাড়লেও খোলা জায়গা ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণের সুযোগ বাড়বে। উচ্চতা বাড়ানোর পাশাপাশি ফ্লোর ইউনিট বা আবাসন ইউনিটের সংখ্যাও প্রায় সব জায়গায় বেড়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি। ফ্লোর এরিয়া রেশিও বাড়ানোর কারণে ফ্ল্যাট নির্মাণের সুযোগ বেড়েছে। যেমন— মূল ড্যাপে পুরান ঢাকায় আবাসন ইউনিটের হার ছিল ১.২, যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে ৩.১ করা হয়েছে। ফলে পুরান ঢাকার পাঁচ কাঠা জমিতে আগে যেখানে সর্বোচ্চ ছয়টি ফ্ল্যাট তৈরি করা যেত, এখন সেখানে ১৩টি পর্যন্ত ফ্ল্যাট নির্মাণের সুযোগ থাকবে।

সংশোধিত ড্যাপের তথ্যানুযায়ী, ইউনিটের হার মোহাম্মদপুরে ১.৭ থেকে বাড়িয়ে ২.৮, পুরান ঢাকায় ১.২ থেকে ৩.১, টঙ্গীতে ১.২ থেকে ৩, রূপগঞ্জে ১.২ থেকে ৩, সাভারে ১.২ থেকে ৩, মিরপুর ডিওএইচএসে ১.৯ থেকে ২.৭, দক্ষিণখানে ফ্লোর ইউনিট ১.৪ থেকে ২.৯, মিরপুরে ১.৭ থেকে ২.৯, শেওড়াপাড়ায় ১.৩ থেকে ৩, মহাখালীতে ১.৯ থেকে ৩.২ এবং খিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় ১.২ থেকে ২.৬ করা হয়েছে।

এই সংশোধনের ফলে ঢাকার অধিকাংশ এলাকাতেই ফ্ল্যাট নির্মাণের সুযোগ ও ঘনবসতি বাড়বে, তবে নির্দিষ্ট খোলা স্থান সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকায় ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের লক্ষ্যও বজায় থাকবে।

‘খসড়া ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা–২০২৫’-এ আগের তুলনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট: আগে প্রতি পাঁচ বছর পরপর অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট নবায়ন করতে হতো। তবে নতুন বিধিমালায় একবার সার্টিফিকেট নিলেই তা আজীবনের জন্য বহাল থাকবে।

স্যুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি): পাঁচ কাঠা বা তার বেশি আয়তনের প্রতিটি প্লটে এখন বাধ্যতামূলকভাবে এসটিপি স্থাপন করতে হবে।

অনুমোদন ফি: আগে ভবন নির্মাণের আবেদন জমা দেওয়ার সময়ই অনুমোদন ফি পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু নতুন নিয়মে ভবন নির্মাণের সুপারিশ পাওয়ার পরেই এই ফি দিতে হবে।

আবেদন নিষ্পত্তির সময়সীমা: আগে যেখানে ৪৫ দিনের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করার বিধান ছিল, এখন সেটি বাড়িয়ে ১৮০ দিন করা হয়েছে।

নতুন সংশোধনী নিয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় পরিবেশ, বসবাসকারী ও আবাসন ব্যবসায়ী— সবার স্বার্থ বিবেচনা করেই ড্যাপের সংশোধন করা হয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ