বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

খুলনায় ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল ‘শেখ বাড়ি’, গডফাদারদের বিরুদ্ধে এখনো কথা বলতে ভয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৪
  • ২০ প্রদর্শন করেছেন

লাল প্রাচীরঘেরা খুলনা নগরের শেরেবাংলা রোডের দোতলা বাড়িটির আনুষ্ঠানিক কোনো নাম নেই, নেই কোনো নামফলক। কিন্তু সবাই একে ‘শেখ বাড়ি’ নামেই চেনেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো পাঁচ ভাইয়ের বাড়ি এটি। শেখ ভাইয়েরা সবাই ঢাকায় থাকলেও খুলনায় এসে থাকতেন এই পৈতৃক বাড়িতে। এই বাড়িকে ঘিরে যেসব কার্যকলাপ হতো, তা কেবল মাফিয়া গডফাদারদের নিয়ে নির্মিত সিনেমাতেই দেখা যায়।

তবে এই শেখ বাড়ি এখন পোড়া একটি বাড়ি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মুখে আগে ও পরে গত ৪ ও ৫ আগস্ট কয়েক দফা হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পর বাড়িটির অবকাঠামো ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। অথচ গত ১৬ বছরে এই বাড়ি হয়ে উঠেছিল খুলনা অঞ্চলের ‘সব ক্ষমতার’ কেন্দ্রবিন্দু। এই বাড়ির নির্দেশনায় চলত খুলনা অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাজনৈতিক নেতারা তো বটেই, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও সংগঠনের নেতারা নিয়মিত হাজিরা দিতেন এই বাড়িতে। বাড়িটি মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম থাকত। বাড়ির সামনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত দামি গাড়ি। রাস্তায় থাকত পুলিশের সরব উপস্থিতি।

গত দেড় দশকে খুলনার যেকোনো সরকারি জনবল নিয়োগে ‘শেখ বাড়ি কোটা’ বলে একটা কথা চালু ছিল। খুলনা অঞ্চলের সব ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, মনোনয়ন–বাণিজ্য, চাকরির নিয়োগ-বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছু চলত এই বাড়ি ঘিরে। শেখ বাড়ি নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই চাপা অসন্তোষ ছিল; কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। এই বাড়িতেই ছিলেন তিনজন সংসদ সদস্য।

শেখ বাড়ির পাঁচ ভাই হলেন শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল, শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল। তাঁদের মধ্যে শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল সংসদ সদস্য ছিলেন। আরেকজন সংসদ সদস্য ছিলেন শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়। শেখ হেলাল ও শেখ তন্ময় সম্প্রতি দেশ ছেড়েছেন। তবে শেখ জুয়েল এখনো দেশ ছাড়ার সুযোগ পাননি বলে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। আর শেখ সোহেল ও শেখ রুবেল জুলাই থেকেই দেশের বাইরে আছেন। মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের কাউকে পাওয়া যায়নি।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, হেলাল কিংবা তাঁর ভাইদের কারও কেন্দ্রীয় বা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ ছিল না। কিন্তু দলে কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে হলে তাঁদের সায় থাকতে হতো। জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহ জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও এই পরিবারের আশীর্বাদ নেওয়া অনেকটাই বাধ্যতামূলক ছিল।

শেখ হাসিনার সর্বশেষ মন্ত্রিসভার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শেখ হেলাল বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের তদবির এড়িয়ে যাওয়ার মতো কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সাহস ছিল না। বিশেষ করে পানিসম্পদ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে শেখ হেলাল পরিবারের দাপট ছিল বেশি।

হেলাল ও তাঁর ছেলে তন্ময়ের বাইরে এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেখ জুয়েল সাম্প্রতিক সময়ে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। এর পেছনে জুয়েলের স্ত্রী শাহানা ইয়াসমিন শম্পার ভূমিকা দেখেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। শাহানা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণভবনে অবস্থান করতেন বেশি। প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তাঁর তদবির বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

রাজনীতিতে শেখ বাড়ির উত্থান

শেখ বাড়ির পাঁচ ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের ছেলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শেখ আবু নাসেরও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁর ছেলেদের মধ্যে সবার বড় শেখ হেলাল উদ্দিন। তিনি বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। বাগেরহাট-১ (চিতলমারী, ফকিরহাট ও মোল্লাহাট) আসনের ছয়বার সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে হেলাল আওয়ামী লীগে সক্রিয় হতে থাকেন। ধীরে ধীরে দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজন হয়ে ওঠেন। এই সময় সরকার বা দলের শীর্ষ কোনো পদে তাঁকে দেখা না গেলেও তাঁর ইশারায় খুলনা বিভাগ তো বটেই, জাতীয় রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ধারিত হয়েছে গত দেড় দশকে।

শেখ বাড়ির অন্য সদস্যরা আগে রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় ছিলেন না। ২০১৪ সালে শেখ সালাহ উদ্দীন ওরফে জুয়েল, শেখ সোহেল উদ্দীন, শেখ জালাল উদ্দীন ওরফে রুবেল, শেখ বেলাল উদ্দীন ওরফে বাবুর সঙ্গে শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময় রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে শুরু করেন। প্রত্যেকের পৃথক প্রভাব তৈরি হতে থাকে।

খুলনা-২ আসনে শেখ জুয়েল অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসেন। খুলনার মানুষ তাঁকে খুব একটা চিনতেন না। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে সংসদ সদস্য হন তখনকার মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। এরপর দলের মধ্যে মিজানুরের আধিপত্য বাড়তে থাকে। বিষয়টি শেখ ভাইয়েরা ভালোভাবে নেননি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে আবির্ভূত হন শেখ জুয়েল। ২৫ অক্টোবর খুলনায় এলে বর্ধিত সভায় তাঁকে খুলনা-২ আসনের নৌকার প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হন শেখ জুয়েল।

হেলালের পথ ধরে ২০১৮ সালে বাগেরহাট-২ (সদর-কচুয়া) আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে হুট করেই রাজনীতিতে আসেন তাঁর ছেলে তন্ময়। জেলায় অনেক পুরোনো নেতা থাকলেও পারিবারিক কোটায় মনোনয়ন পান অপরিচিত এই মুখ। এরপর ২০২৪ সালেও তন্ময় সংসদ সদস্য হন।

শেখ সোহেল যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, খুলনা ক্লাবের সভাপতি, খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি, বিসিবির পরিচালক, বিপিএলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। শেখ রুবেল হয়েছিলেন খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের সহসভাপতি।

জাহাজের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ

খুলনার নৌপরিবহন মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেখ পরিবারের পাঁচ ভাই, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে রয়েছে শ খানেক জাহাজ। ২০১১ সাল থেকে খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপটি ছিল শেখ ভাইদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শেখ জুয়েল। ২০১৭ থেকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শেখ সোহেল। কমিটির সহসভাপতি ছিলেন তাঁদের আরেক ভাই শেখ রুবেল। তাঁরা ভোট ছাড়াই কেবল প্রভাব খাটিয়ে এসব পদ দখলে রেখেছিলেন।

নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের কয়েকজন সাবেক পরিচালক প্রথম আলোকে জানান, মোংলা বন্দরে জাহাজ চলাচল বাড়লেও স্থানীয় নৌযানের মালিকেরা তাতে লাভবান হননি। শেখ পরিবার ও তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট মালিকদের জাহাজে পণ্য সরবরাহের পর অন্য মালিকেরা পণ্য সরবরাহের কাজ পেতেন। ফলে অনেক ব্যবসায়ীর নৌযানগুলো দিনের পর দিন অলস পড়ে থাকত। শেখ পরিবারের দাপটে অনেকেই নিজের ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছেন। বিক্রি করে দিয়েছেন জাহাজ।

কেবল শেখ হেলাল ও তাঁর স্ত্রী-ছেলের নামেই ২২টি জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার ১৪টি শেখ হেলালের, ৬টি তাঁর ছেলে তন্ময়ের ও ২টি হেলালের স্ত্রী রুপা চৌধুরীর নামে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পণ্যবাহী নৌযান নিবন্ধন-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

২০২১ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া কার্গো জাহাজ এমভি এসকেএল-৩ ছিল শেখ তন্ময়ের মালিকানাধীন এসকে লজিস্টিকসের। ওই ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু হয়।

টাকা দিলেই মনোনয়ন

শেখ হাসিনার বিগত তিনটি পূর্ণ মেয়াদের সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা মনোনয়ন পাননি কেবল শেখ ভাইদের টাকা দেননি বলে। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদ থেকে শুরু করে সংসদ সদস্যের মনোনয়নে পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করত খুলনার শেখ বাড়ি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, টাকার বিনিময়ে অনেককে শেখ ভাইয়েরা নৌকার মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে দেওয়া নৌকার প্রার্থী পছন্দ না হলে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী দাঁড় করাতেন তাঁরা।

খুলনার একটি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে হেরে যাওয়া এক প্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শেখ বাড়িতে কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এরপর পুলিশ প্রশাসন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়।’

ইউপি সদস্য পদের জন্যও টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে হেলাল-তন্ময়ের বিরুদ্ধে। তাঁদের প্রভাবে ২০১৬ ও ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে বাগেরহাটে দেশের সর্বোচ্চ ৩৯টি ও ৩৪টি ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন তাঁদের অনুসারীরা। দলের একটি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য প্রত্যেক চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন তাঁরা। ২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য তাঁদের দিতে হয়েছে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা করে।

বাড়িতে তুলে এনে চাপ

খুলনা জেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা। খুলনা-১ আসনের অন্তর্গত এই ইউপিতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের দুই দিন আগে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থী বিধান রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী (বিদ্রোহী) সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আশিকুজ্জামান (আশিক) ও মো. গফুর মোল্লা সরে দাঁড়ান। স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় তাঁরা বিজ্ঞাপন দিয়ে এ ঘোষণা দেন। বিধান রায় শেখ সোহেলের প্রার্থী ছিলেন।

শেখ আশিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করা হয়, নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দেওয়া হয়। আমাকেও সাজানো হত্যা মামলায় আসামি করার প্রক্রিয়া হচ্ছিল। অবশেষে ২০-৩০টি মোটরসাইকেল নিয়ে আমাকে শেখ বাড়িতে তুলে আনা হয়। আমি যাওয়ার পর শেখ সোহেল আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেন। আমি আরেকটিবার সুযোগ চাইলাম। তিনি বললেন, “কিছু করার নেই। এই কাগজে একটা সই করেন।” থানা থেকে আমার কর্মীদের ছেড়ে দেওয়ার শর্তে আমি সই করে চলে আসি। পরদিন দেখি আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি, এ রকম একটা বিজ্ঞাপন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।’

২০১৫ সালে বাগেরহাট পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ায় বহিষ্কৃত হন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনা হাসিবুল হাসান। ভোটে জিতলেও হাসিবুলকে পরাজিত দেখিয়ে শেখ হেলাল মনোনীত মেয়র প্রার্থী খান হাবিবুর রহমানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এর পর থেকে জেল-জুলুমসহ নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে হাসিবুলের ওপর। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এলাকার বাইরে থাকতে হয়েছে তাঁর অনুসারীদের।

নিয়োগ-পদায়ন বাণিজ্য

গত দেড় দশকে খুলনার চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো ধরনের জনবল নিয়োগে শেখ বাড়ির সুপারিশ প্রধান যোগ্যতা হতে হতো একজন চাকরিপ্রত্যাশীর। খুলনার শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিন্ডিকেট সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগে শেখ বাড়ির ব্যাপক প্রভাব ছিল। তাঁদের পক্ষ হয়ে কেসিসির সাবেক প্যানেল মেয়র আলী আকবর নিয়োগগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বাগেরহাট জেলায় কোন থানায় কে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হবেন, সে জন্য শেখ হেলালের ব্যক্তিগত সহকারীদের কাছে টাকা দিতে হতো। সাম্প্রতিক সময়ে বাগেরহাটের দুটি থানার ওসির পদায়নে ২০ লাখ টাকা করে নেওয়ার কথা জানিয়েছে ওই সূত্র।

ইজারা থেকে নিতেন কমিশন

খুলনার ২৩টি মৌজায় ৪৯ একর জায়গাজুড়ে ‘বটিয়াঘাটা বালুমহাল’। তিনজন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেন, এই বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ সোহেলের হাতে। রূপসা সেতুর পর থেকে বটিয়াঘাটার বরণপাড়া এলাকা পর্যন্ত যেখানে বালু উত্তোলন করা হতো, সেখান থেকে বালুর বখরা ঢুকত তাঁর পকেটে। প্রতি বর্গফুট বালু উত্তোলনের জন্য ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা ১৫ পয়সা পর্যন্ত কমিশন দিতে হতো তাঁকে। এমনকি বালুর কমিশনের টাকা নগদ মেটাতে হতো। শেখ সোহেলের নামে প্রতিদিন কম করে হলেও পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা বালুর ব্যবসা থেকে তোলা হতো। এ ছাড়া হেলাল ও তাঁর ছেলে তন্ময়ের আশীর্বাদ ছাড়া মিলত না বাগেরহাটের কোনো হাট-ঘাট ইজারাও। স্বল্প মূল্যে নিজের লোকদের ইজারা পাইয়ে দিতেন তন্ময়।

ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ

দলীয় নেতা-কর্মী ও ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেখ বাড়ির সঙ্গে লিয়াজোঁ করে অনেকে দরপত্র পেতে তদবিরকারীর ভূমিকা পালন করতেন। কয়েক বছর ধরে শেখ সোহেল নিজেই ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা রাখতেন।

খুলনার অন্তত সাতজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেখ পরিবারকে ১০ শতাংশ টাকা দিয়ে তবেই যেকোনো কাজ নিতে হতো। গত কয়েক বছরে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এভাবে সড়ক ও জনপথ (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), গণপূর্ত ও বিদ্যুতের কয়েক শ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। দরপত্র পেতে দলীয় লোক হতে হবে, এমন কথা নেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বড় নেতারাও শেখ বাড়ির মাধ্যমে কাজ পেয়েছেন।

অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি

২০১৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী, শেখ জুয়েলের বার্ষিক আয় ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ। ২০২৩ সালে বার্ষিক আয় হয়েছে ৭ কোটি ২৮ লাখ ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। কার্গো ও ফিশিং ট্রলার সম্পদ হিসেবে দেখালেও তাতে বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখ করেননি।

শেখ হেলালের ২০০৯ সালের হলফনামায় বার্ষিক আয় ছিল ৮ লাখ টাকা। ওই সময় তাঁর স্ত্রীর আয় দেখানো হয়নি। ২০২৩ সালের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, শেখ হেলাল ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় দেখান ৫০ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে ব্যবসা থেকে বছরে তাঁর স্ত্রীর আয় দেখান সাড়ে ২৯ লাখ টাকা। ২০০৯ সালের হলফনামায় শেখ হেলালের অস্থাবর সম্পদ ছিল ৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকার এবং স্ত্রীর নামে ছিল ৪৫ লাখ টাকার।

২০১৮ সালের হলফনামায় শেখ তন্ময়ের ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ এবং ৫৩ লাখ টাকার দুটি নৌযান ছিল। ২০২৩ সালের হলফনামা অনুযায়ী, শেখ তন্ময়ের ব্যবসা, শেয়ার ও সংসদ সদস্য ভাতা থেকে বার্ষিক আয় দেখানো হয় ৯৫ লাখ টাকা। তাঁর বাবার অফিস যে ভবনে, সেই ভবনে শেখ লজিস্টিকস নামে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে তাঁর কাছে ২ কোটি টাকা মূল্যের ৩টি গাড়িসহ ৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা জমি রয়েছে।

তবে নির্বাচন ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া শেখ ভাইদের সম্পদ বিবরণীতে যে তথ্য আছে, তা তাঁদের প্রকৃত সম্পদের সামান্য অংশ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ