সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১০ অপরাহ্ন

নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন: উপকূলে কোরাল মাছ চাষে বিপুল সম্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৪
  • ২১ প্রদর্শন করেছেন

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কোরাল মাছ চাষের চেষ্টা চলছে। এখানে কোরালের খাবার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ, তেলাপিয়া বা অন্যান্য মাছ ব্যবহার করা হয়। তবে কৃত্রিম খাদ্যের অভাবে কোরাল মাছের চাষ পদ্ধতি তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিশ প্রকল্পের অর্থায়নে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুয়াকালচার বিভাগ ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ উপ-প্রকল্পের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন এই প্রযুক্তির গবেষণায় গবেষকরা দক্ষিণাঞ্চলে কোরাল মাছ চাষে নতুন এক সফলতা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন।

পটুয়াখালীর আলীপুরে চলা নতুন এই গবেষণা উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক ও সহকারী প্রধান গবেষক হিসেবে আছেন ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুর রহমান।

বাংলাদেশে কোরাল মাছের হ্যাচারি না থাকায় গবেষণা কাজে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের পোনা সংগ্রহ করে নার্সারি পুকুরে নার্সিং করার পর মজুদ পুকুরে মজুদ করা হয়।  নার্সারি পুকুরে কোরাল মাছের পোনাকে সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে ৫০ ভাগ আমিষ সমৃদ্ধ কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ করা হয়। এ সময় কোরালের পোনাকে দেহ ওজনের ২০-৮% কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করা হয়। দিন-রাতে মোট ৪ থেকে ৬ বার খাবার দেওয়া হয়। ০.২ গ্রামের কোরাল পোনা ৫ গ্রাম ওজনের হলে পুকুরে মজুত করা হয়।

এই গবেষণা উপ-প্রকল্পের গবেষকরা ১ টি গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন।  গবেষণাতে কোরালের অধিক বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম খাদ্যে সামুদ্রিক শৈবালের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে কৃত্রিম খাদ্যে ০% থেকে ২০% হারে সামুদ্রিক শৈবাল প্রয়োগ করে কোরাল মাছকে খাওয়ানো হয়েছে। যে কৃত্রিম খাবারে ১০% সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে মাছের উৎপাদন বেশি পাওয়া গেছে। আরও ২ টি গবেষণা কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

দ্বিতীয় গবেষণাতে কোরাল মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ এবং তৃতীয় গবেষণাতে কোরাল মাছের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত খাদ্য নির্ধারণে গবেষণা কার্যক্রম চলছে। এছাড়া পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, প্লাংটনের প্রাচুর্যতা, মাছে ও পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।

এতে দেখা গেছে শতাংশে ২০ টি কোরাল মাছ মজুত করে ১০% সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাবার ব্যবহারে মাছের উৎপাদন বেশি পাওয়া গেছে। এ সময় কোরাল মাছকে দেহ ওজনের ৬-১% কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করা হয়। মাছকে ২ বার খাবার দেওয়া হয়। কোরাল মাছ নিশাচর হওয়ায় অর্ধেক খাবার প্রত্যুষে বাকী অর্ধেক খাবার গোধূলিতে প্রয়োগ করা হয়।

৫ গ্রামের কোরাল ১ বছরে ২-৩.৫ কেজি ওজনের হয়েছে যা দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যচাষীদের কাছে ছিল অকল্পনীয়। এই গবেষণা উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে সুফলভোগীদের মাঝে মাছ চাষের সকল উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ২৫০ জন মৎস্যচাষী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

উপ-প্রকল্পের সুফলভোগী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের তত্ত্বাবধানে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস হতে শুরু করে এই বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এক একটি কোরাল ৩.৫ থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে চাষীরা ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হতে পারবে।

মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিশ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শরিফুল আজম জানান, থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের পোনাকে সিউইড সহযোগে পিলেট খাদ্যের মাধ্যমে চাষ করে ১ বছরে ৩-৩.৫ কেজি হওয়ায় আমরা আশাবাদী। চাষকালীন কোরাল মাছের আাকারের তারতম্য খুব বেশি হওয়ায় ছোট মাছগুলোকে ছাটাই করে অন্য পুকুরে স্থানান্তর করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের চাষ পদ্ধতি নিয়ে তার দল কাজ করছেন। ৫ গ্রামের কোরাল মজুদ পুকুরে ১ বছরে চাষ করে ২ থেকে ৩.৫ কেজি ওজনের হওয়ায় শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয় পুরো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যচাষীদের কাছে নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, তাদের উদ্ভাবিত সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ প্রযুক্তি বাংলাদেশে কোরাল মাছের উৎপাদন তথা বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।

উল্লেখ্য, কোরাল মাছ বেশ পুষ্টিসমৃদ্ধ। এ মাছে উন্নতমানের আমিষ রয়েছে যা আমাদের শরীরের পেশী গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরামত এবং হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। কোরাল মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি সমৃদ্ধ উৎস। বিশেষ করে ইপিএ (ইকোসাপেন্টানোয়িক অ্যাসিড) ও ডিএইচএ (ডোকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড) এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নয়ন করে, প্রদাহ কমায় এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও কোরাল মাছে ভিটামিন এ, বি১২, ডি ও ই, খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম, জিংক, লৌহ, আয়োডিন, ফসফরাস এবং সিলেনিয়াম যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। এগুলো শরীর গঠন ও বৃদ্ধির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ