সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭ অপরাহ্ন

সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট পায়রাবন্দরের পরিচালক, তিনি কে?

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৭ প্রদর্শন করেছেন

পায়রাবন্দরের কেনাকাটায় বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিনা দরপত্রে ৬০ কোটি টাকার ম্যাটেরিয়াল হ্যান্ডেলার ক্রয় করা হয়েছে। একইভাবে ক্রয় করা হয়েছে ৯ কোটি টাকার প্রাইম মুভার ও সাড়ে ৯ কোটি টাকার ২৮টি ট্রেইলার কনটেইনার। ক্রয়কৃত এসব ইক্যুইপমেন্ট দিয়ে বন্দরের মালামাল লোড-আনলোড করা হয়। এছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নসংক্রান্ত একটি প্রকল্পের বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৮৬ কোটি টাকা। টাগবোট ক্রয় না করেই বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া প্রকল্পটিতে ১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা খরচেও পাওয়া গেছে বিস্তর অনিয়ম। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এ ধরনের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ১৩টি অডিট আপত্তি তুলেছিল পরিবহণ অডিট অধিদপ্তর। একই সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এরকম নানা অনিয়মের চিত্র। সেই সঙ্গে সংস্থাটি অডিট আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়েছে। তা ছাড়া চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে সাব-কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে ১ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকার কাজ করা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট পায়রাবন্দরের একজন প্রভাবশালী পরিচালক ও তার পরিবারের কতিপয় সদস্যের যোগসাজশে হয়েছে বেশিরভাগ অনিয়ম-দুর্নীতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান থেকে শুরু করে সবশেষ খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর খুবই ঘনিষ্ঠভাজন ছিলেন ওই পরিচালক। এ কারণে তিনি কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। খোদ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলন, ধর্মঘট হলেও তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। অভিযোগ আছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি বোল পালটে সরকারের সঙ্গে মিশে যান। যার কারণে বন্দরের বেশিরভাগ প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করা হলেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। শুধু তিনিই নন, তার পরিবারের সব প্রভাবশালী ঠিকাদাররাও এখনো বন্দরের সব কেনাকাটা ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়া পায়রাবন্দরের জন্য চীন থেকে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (৬০ কোটি টাকা) ম্যাটেরিয়াল হ্যান্ডেলার ক্রয় করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি একটি বেসরকারি ব্যাংকের এলসি নং- ০০০০২১৪৯২৪০১০৫১৯।

অভিযোগ আছে এই কেনাকাটা থেকে ওই সিন্ডিকেট কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ কমিশন বাণিজ্য করেছে। এছাড়াও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিন্ডিকেট বিনা টেন্ডারে প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২৮টি কনটেইনার ট্রেলার চীন থেকে ক্রয় করেছেন। একটি সরকারি ব্যাংকের এলসির মাধ্যমে গত বছর ২৬ ডিসেম্বর এই কেনাকাটা হয়। এছাড়া প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ২টি রিচ ট্র্যাকারও চীন থেকে ক্রয় করে বিনা টেন্ডারে। ওই ক্রয় প্রক্রিয়াটিও হয় একটি সরকারি ব্যাংকের এলসির মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, এই সিন্ডিকেট সদস্যরা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ২০টি প্রাইম মুভারও চীন থেকে ক্রয় করে।

অভিযোগ আছে পায়রা বন্দরের ওই পরিচালকের পারিবারিক একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেশিরভাগ কেনাকাটা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হলো ওয়াটার বার্ডস লিমিটেড। এটি মূলত ওই পরিচালকেরই পরোক্ষ মালিকানা প্রতিষ্ঠান। মহাখালী ডিওএইচএসের ৮ নাম্বার রোডের একটি বাড়িতে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়। ওই বাড়িতে ওয়াটার বার্ডস লিমিটেড ছাড়াও গ্রীনডট লিমিটেড নামে আরেকটি অফিস আছে ওই পরিচালকের নিজস্ব। এ দুটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিচালিত হতো পায়রাবন্দরের সব ধরনের কেনাকাটা আর উন্নয়ন কাজ। জানা গেছে, ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে সপরিবারে বসবাস করেন পায়রাবন্দরের ওই প্রভাবশালী পরিচালক। মূলত ওই বাড়ি থেকে পায়রাবন্দরের বিভিন্ন কেনাকাটা ও উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার শিডিউল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেখানে বসেই লেনদেন হয় বড় অঙ্কের টাকার কমিশন বাণিজ্য। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ছাত্রজনতার গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতিবাজ অনেকে পালিয়ে গেলেও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন পায়রাবন্দরের ওই পরিচালক।

সরকারের আর্থিক ক্ষতি : আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, পায়রাবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নসংক্রান্ত একটি প্রকল্পে নিয়ম এবং সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালা (পিপিআর) না মানায় সরকারের ২৮৬ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অগ্রিম বিল পরিশোধের সময় আয়কর ও ভ্যাট কাটা হয়নি। অন্যান্য বিল পরিশোধে কম ভ্যাট কাটা হয়েছে। ফলে সরকারের ২৬ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বিলম্ব জরিমানা ব্যতীত বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৯০ লাখ ২০ হাজার টাকা। পিপিআর-২০০৮ এবং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ঠিকাদার বিমা না করায় প্রিমিয়ামের ভ্যাট বাবদ সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।

এছাড়া ডিপিপিতে সংস্থানকৃত অর্থের চেয়ে অধিক মূল্যে চুক্তি করে বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। প্রকৃত আয়তন অপেক্ষা অতিরিক্ত আয়তনে ইম্প্রুভ সাবগ্রেডের পরিমাণ অন্তর্ভুক্ত করে বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। চুক্তিকৃত পরিমাণ অপেক্ষা অধিক বিল পরিশোধ করায় সরকারের ১ কোটি ১১ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে সমন্বয় না করে প্রয়োজনীয় নিরূপণ ব্যতীত বার্থিং-আনবার্থিংয়ের জন্য ইয়ার্ড ও জেটি নির্মাণের পূর্বেই সংযোগ নদীর ড্রেজিং সম্পন্ন করে বিল পরিশোধ করায় সংস্থার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২২৭ কোটি ৫৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। পিপিআর-২০০৮-এর নির্দেশনা লঙ্ঘন করে গাড়ির ব্র্যান্ড উল্লেখ করে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে প্রকৃত সরবরাহকারী ব্যতীত পূর্ত কাজের ঠিকাদারের মাধ্যমে গাড়ি কেনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে অবস্থিত ঘরবাড়ি, গাছপালা ও অন্যান্য স্থাপনা নিলামে বিক্রি না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। নিলামে বিক্রি না করে বিনামূল্যে ঘরবাড়ি, গাছপালা এবং অন্যান্য স্থাপনা অপসারণ করায় ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।

উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির পরিবর্তে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে অদক্ষ ঠিকাদারের মাধ্যমে কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে ২২৬ কোটি ৩৩ লাখ ৭১ হাজার টাকা, যা ডিপিপির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একটি টাগবোট কেনায় ১৮ মাসের মধ্যে সরবরাহের চুক্তি করে ১২ মাস সময় বাড়ানোর পরও অননুমোদিতভাবে ৩৬ মাস অতিবাহিত হলেও টাগবোট পাওয়া যায়নি। তবে বোট না পেলেও ৩০ কোটি ৮৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

আইএমইডির প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, পায়রাবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা সুবিধাদির উন্নয়ন ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পটি জুলাই ২০১৫ থেকে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি দুবার সংশোধন হয়েছে। প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যায় ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা এবং দুই বছর সময় বাড়িয়ে জুন ২০২০ মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। তবে নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় ফের ১ হাজার ২৪ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে দুই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। জুন ২০২২ মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় ফের এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। তাতেও কাজ শেষ না হলে আরও এক বছর অর্থাৎ জুন ২০২৪ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

পায়রাবন্দরের একটি সুরক্ষা দেওয়াল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই হেলে পড়ার অভিযোগ আছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে আরও একটি দেওয়াল। বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, এবিএম ওয়াটার কোম্পানি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সীমানা গাইডওয়াল ও সাইড ডেভেলপমেন্টের কাজ পায়। দুই-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হওয়ার পর বন্দরের কোয়ার্টারসংলগ্ন উত্তর পাশের দেওয়ালটি খালের দিকে হেলে পড়ে। এ কাজে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এলাকাবাসী ও বন্দর কর্মকর্তাদের। ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানালেও শেষ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জানা গেছে, অভিযুক্ত ওই কোম্পানিটি বন্দরের ওই প্রভাবশালী পরিচালকের ভাইয়ের কোম্পানি।

এ প্রসঙ্গে পায়রাবন্দরের প্রকল্প পরিচালক নাসির উদ্দিনের সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে অভিযোগগুলোর নাম উল্লেখ করে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হলে তিনি ‘তাই নাকি’ বলে উত্তর দেন এবং ‘ভেরি গুড’ বলে জানান।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ