নাম মো. ইদ্রিস কোম্পানী।গাছকাটা, মাটিকাটা, পাহাড়কাটা, জমি দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন, প্রতারণা, সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাতসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেননি তিনি।আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করতেন।এলাকায় তার কথাই যেন শেষ কথা।এলাকায় যত অপকর্ম হতো, সবই তার নেতৃত্বেই হতো।
ইদ্রিস কোম্পানী থাকেন পুরাতন বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়নে, আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে বনে যান লামা উপজেলার সরই ইউপি চেয়ারম্যান। এরপর থেকে একক নিয়ন্ত্রণে নেন পুরো ইউনিয়ন। এ চেয়ারম্যানের পদটি পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে তিনি শতকোটি টাকার মালিক বনে যান।
গাছ ব্যবসা দিয়ে শুরু, এরপর কী করেননি তিনি। নানা ধরনের প্রতারণা, ইউনিয়নের বিভিন্ন খাল থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, একাধিক ব্যক্তি মালিকানার জমি দখলসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। হয়েছেন অবৈধ ইটভাটার মালিক, ইউনিয়নের অবাধে পাহাড় কাটার জন্য কিনেছেন এক্সকেভেটর, মাটি বহন করার জন্য কিনেছেন একাধিক ড্রাম ট্রাক। ইউনিয়নের হাসপাতাল পাড়া এলাকায় বিশাল পাহাড় কেটে নির্মাণ করেছেন কোটি টাকার আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরই ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সরই বাজারে চারতলা মার্কেট যার আনুমানিক মূল্য কোটি টাক। একই ওয়ার্ডের হাসপাতাল পাড়া এলাকায় ১০ একর রাবার প্লট যার আনুমানিক মূল্য প্রায় কোটি টাকা। একই এলাকায় পাহাড় কেটে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করছেন বিলাশবহুল আলিশান ডুপ্লেক্স ‘রাজপ্রাসাদ’। আন্দারী এলাকার ৭নং ওয়ার্ডে তার রয়েছে আনুমানিক ৩০ লাখ টাকা মূল্যের পাঁচ একর রাবার প্লট।
অপরদিকে লোহাগাড়ার পুটিবিলা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে তার নিজ বাড়িতে গাছের ডিপোসহ বিশাল করাত কল, যার আনুমানিক মূল্য তিন কোটি টাকা। একই এলাকায় গড়ে তুলেছেন গজই নামে অবৈধ ইটভাটা, যার আনুমানিক মূল্য পাঁচ কোটি টাকা। একই ইউনিয়নের লাগড়ীপাড়া এলাকায় প্রথম শ্রেণির ৮০০ শতক জমি যার আনুমানিক মূল্য দুই কোটি টাকা। লামা ও লোহাগাড়া এলাকার পাহাড়ের মাটি কাটার জন্য কিনেছেন আনুমানিক ৩০ লাখ টাকা মূল্যের দুটি এক্সকেভেটর। পাহাড়ের মাটি ও অবৈধ বালু বহন করার জন্য কিনেছেন আনুমানিক ৬০ লাখ টাকা মূল্যের চারটি ড্রাম ট্রাক। এত সম্পদের পরও সরকারকে আয়কর ফাঁকি দিতে আয়কর রিটার্ন ফাইলে নিট সম্পদের বিবরণী দিয়েছেন শুধু ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ ইটভাটা নির্মাণ, আবার সেই ভাটার চুল্লির জন্য বনজসম্পদ ধ্বংস করে লাকড়ি, ইট তৈরি করতে পাহাড়ের মাটি ও বালু জোগান দেন তিনি। টংগঝিরি এলাকার ত্রিপুরা পাড়াবাসীদের উচ্ছেদ করে ভূমি দখল, ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে তার ইউনিয়নে টংগঝিরি এলাকায় প্রায় অর্ধশত ত্রিপুরা পরিবারকে উচ্ছেদ করে কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে শত শত একর জায়গা জোরপূর্বক দখল দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্ট হাসিনার ভারতে পালানোর পর বেনজীর আহমেদও পালিয়ে যাওয়ায় তার আশা জলে ভেসে যায়। ফলে ওই এলাকার জায়গাটি আর বেনজীরকে দখল দিতে পারেননি তিনি।
জায়গা দখল নিয়ে গণেশ ত্রিপুরা, চন্দ্রমনি ত্রিপুরা, সত্যমনি ত্রিপুরাসহ স্থানীয়রা জানান, ইদ্রিস চেয়ারম্যান ও তার সহযোগী স্থানীয় কিছু নেতাসহ বেশ কয়েকজনের প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকির কারণে যে কোনো মুহূর্তে পাড়া ছাড়তে হবে এমন আতঙ্কে দিনরাত পার করছেন অবহেলিত ত্রিপুরা পরিবারগুলো। প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এমনকি মানববন্ধন করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। তাদের দাবি, এখনই যেন সরকার আওয়ামী লীগের দোসরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। তারা এখানে প্রায় অর্ধশত পরিবার ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসাবাস করছেন। কয়েকদিন তাদের উচ্ছেদ করতে চেষ্টা করেছিলেন বেনজীর আহমেদ। এখন আবার নতুন করে আওয়ামী লীগ নেতা ও তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে চাইছে। তারা এটি নিয়ে কয়েকবার মানববন্ধনও করেছেন। তাদের মতে প্রশাসন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে তারা আবার সক্রিয় ও একতাবদ্ধ হচ্ছে। এখনো সময় আছে, নয়তো তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এ সময় তারা ইদ্রিস চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। প্রয়োজনে তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করারও হুঁশিয়ারি দেন।
এ বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ইদ্রিস কোম্পানী বলেন, ‘আমি কোনো প্রকল্প থেকে এক টাকাও অনিয়ম করিনি, যা টাকা পেয়েছি তা দিয়ে কাজ করেছি।’ অস্বাভাবিক সম্পদের বিষয় অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এলাকায় নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আমি অনেক আগে থেকেই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।’