সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন

রায়পুরে মেঘনার চর দখলে নিতে মরিয়া বিএনপির নেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৫ প্রদর্শন করেছেন

শেখ হাসিনার পতনের পর লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরের পশ্চিমে মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা দুর্গম চরের জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে স্থানীয় বিএনপির নেতারা। মেঘনার ভাঙনের শিকার ভিটামাটি হারানো হাজারও মানুষ একটু মাথা গোঁজার জন্য ছুটে যান দুর্গম চরাঞ্চলে। দুই হাজার সাতশত একরের বিশাল চরাঞ্চলের এসব অনাবাদি জমিকে আবাদি করে তুলতেই প্রভাবশালীদের নজর এখন এই চরে।

এদিকে নভেম্বর মাসে উত্তর ও চরবংশী ইউপির মেঘনার চরাঞ্চলে কোন কোন ব্যক্তির জমির দলিল রয়েছে তা নিয়ে দেখা করার জন্য মাইকিং করেছেন উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন বিএনপি আহ্বায়ক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা গাজিসহ বিএনপি নেতারা।

তবে মোস্তফা গাজি জানান, গত ১৭ বছর ভূমি দস্যু আলতাফ মাস্টারসহ কয়েকজন আ’লীগ নেতার দখলে ছিল চরের সরকারি খাস জমি। এসব জমি এখন উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার (২০ ও ২১ ডিসেম্বর) মেঘনার চর, মাছঘাট ও বাজার দখলকে কেন্দ্র করে তিন দফায় উপজেলা সেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব শামিম গাজিসহ তার অনুসারী এবং উত্তর চরবংশী ইউপির বিএনপির সহসভাপতি ফারুক গাজীসহ তার অনুসারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দলীয় কার্যালয়, মাছের আড়ত, বসতঘর, দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। একইসঙ্গে দুটি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিএনপির উভয়পক্ষকে ধাওয়া করে পরিস্থিতি শান্ত করেন সেনা সদস্যরা ও ফাঁড়ি পুলিশ ।

এ ঘটনায় শনিবার (২২ ডিসেম্বর) বিকালে রায়পুরের সাবেক এমপি আবুল খায়ের ভূঁইয়ার নির্দেশে উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দু সংবাদ সম্মেলন করে উত্তর চরবংশী ইউপির বিএনপিসহ তার সহযোগী সংগঠনের সকল কমিটি বিলুপ্ত করেছেন।

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেডএম নাজমুল ইসলাম মিঠুসহ ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরবংশী ও উত্তর চরআবাবিল ইউপির মেঘনার চরাঞ্চলের এসব জমিতে ভূমিহীনদের সরকারিভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা থাকলেও পুনর্বাসনের নামে একশ্রেণির অসাধু ভূমি কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই ভূমি চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের দখলে।

ইউপি চেয়ারম্যান ও আ’লীগ নেতা আবুল হোসেন, আবু সালেহ মিন্টু ফরাজি ও আবু জাফর দুলাল হাওলাদার সত্যতা শিকার করে বলেন, আগে দখলে ছিল আ’লীগের, এখন বিএনপির। আমরা কিছুই বলতে পারছি না।

অপরদিকে- চরের জমি প্রভাবশালীদের দখলের অভিযোগ ওঠায় তদন্ত করতে এসব অঞ্চল পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসক চরের বাসিন্দা ও ভূমিহীনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন।

পতিত আ’লীগ সরকারের সময় মেঘনা চরের অসহায় মানুষে মুখে ফুটে উঠেছিল সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আ’লীগ নেতা আলতাফ হোসেন মাস্টার জবরদখলের চিত্র। এবার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা গাজির নেতৃত্বে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা চরের জমি কার দখলে রয়েছে, তা মাফ করছেন।

উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী ইউপির চরঘাসিয়া, টুনুর চর, চর কানিবগা ও চর কাচিয়াসহ চরাঞ্চল ঘুরে মাহমুদ আলী, জয়নাল আবেদিন ও ফারুক হোসেনসহ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চরে বসবাস করছেন ভিটেমাটি হারানো কয়েক হাজার পরিবার। এসব লোকজন চরের অনাবাদি জমি চাষাবাদ করে আবাদি করে তুলছেন। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশে সরকারের খাস জমি বছরের পর বছর অবৈধভাবে দখল করে রেখেছিলেন রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেনসহ তার অনুগতরা। পরে মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভূমিহীনদের কাছ থেকে ইজারা হিসেবে প্রতি একর জমি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করছিলেন তারা।

রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ মাস্টারসহ তার অনুসারী সাবেক মেম্বার মফিজ খান, আবুল মাল ও ফারুক ছৈয়ালসহ কয়েকজন অনুগত চরঘাসিয়া, চরকানিবগা ও চরকাচিয়ায় কয়েকশ একর খাস জমি বছরের পর বছর দখল করে রেখেছিলেন। কোনো ভূমিহীন লোক এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে পারেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৭ জন দিনমজুর ও কৃষক জানান, গত ১৭ বছর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ মাস্টারের দখলে ছিল চরের বিশাল খাস জমি। শেখ হাসিনার পতনের পর গত দুই মাস ধরে স্থানীয় সকল দলের ৩০-৫০ জনের দলবদ্ধ স্থানীয় বিএনপির নেতারা চরটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. মামুন জানান, মেঘনার বুকে জেগে ওঠা সরকারি খাস জমি এতোদিন আ’লীগের নেতা আলতাফ মাস্টারসহ কয়েকজন আ’লীগ নেতার দখলে ছিল। এখন প্রভাবশালী চক্র মেঘনার চরটি আবারও দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আমাকে ম্যানেজ করতে দুই নেতা আসছিলেন। আমি রাজি না হওয়া দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে যান। বর্তমানে এসব চরে প্রায় ২ হাজার ৭০০ একর সরকারি খাস সম্পত্তি দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা।

রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন জানান, চরাঞ্চলের কয়েকশ’ একর সম্পত্তি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আমার সম্পত্তি এতদিন আমার দখলেই ছিল। সরকার পতনের পর বিএনপির উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী ইউপির নেতারা চরগুলো দখলে নিয়ে।

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাজমুল ইসলাম মিঠু ও সদস্য সচিব শফিকুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, উত্তর চরবংশী ইউপির বিএনপি ও সেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় ওই ইউনিয়নের বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠনের সকল কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার জানান, শুধুই রায়পুরের মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চর নয়, চারটি উপজেলার আওতাধীন চরগুলো প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে চরগুলোতে পরিদর্শনে যাব। চরাঞ্চলে সরকারের যে খাস সম্পত্তি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে, তার একটি তালিকা তৈরির কাজ চলমান।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ