স্বামী পালিয়ে যাবে বিদেশে, প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে দেবর
সুমিকে হত্যা করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে স্বামী, সহায়তা করেন শ্বাশুড়ি, দেবর ও ননদ
দুবাই প্রবাসী স্বামী আবদুল আউয়াল। আট বছর আগে বিয়ে হয় সুমি আক্তারের সঙ্গে। তাদের ঘরে তিনটি সন্তান রয়েছে। দুই-তিন বছর পর বিদেশ থেকে দেশে আসতেন আউয়াল। এই আট বছরের মধ্যে যখনই বিদেশ থেকে দেশে আসতেন, তখনই স্বামীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন আউয়াল। আর সারাবছর আউয়ালের মা, বোন ও ভাই সুমিকে মারধর ও নির্যাতন করতেন। কখনো যৌতুকের জন্য, আবার কখনো মা-ভাই ও বোনের কথায় কারণে-অকারণে সুমিকে মারধর ও নির্যাতন করতেন আউয়াল। তিনটি সন্তান হওয়ার পরও আট বছরের মধ্যে আউয়াল তার স্ত্রীকে কখনো একটি বাটন ফোনও কিনে দেননি।
এক নির্যাতনের পরও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে গরীব বাবা-মায়ের ঘরে যাননি সুমি। মাত্র একমাস আগে দেশে আসেন আবদুল আউয়াল। সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনের জন্য কয়েকটি দামি ফোন নিয়ে আসেন। তার মধ্যে একটি ফোন ঘর থেকে হারিয়ে গেছে-এমন অজুহাত তুলে সুমিকে কয়েকদিন মারধর ও নির্যাতন করেন স্বামী। নির্যাতনে সহায়তা করেন শ্বাশুড়ি জাহেরা বেগম, ননদ সরু আক্তার ও দেবর শফিকুল ইসলাম।
২৪ মার্চ ২০২৫ সোমবার। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সুমিকে শ্বাশুড়ি, ননদ ও দেবরের সহায়তায় ব্যাপক মারধর ও নির্যাতন করেন স্বামী আউয়াল। এক পর্যায়ে সুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আউয়াল সুমিকে রুমে রেখে নামাজ পড়তে যায়। নামাজ থেকে এসে দেখেন সুমি মারা গেছেন। তড়িঘড়ি করে মা, বোন ও ভাইয়ের সহায়তায় আউয়াল সুমিকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। আশপাশের লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে গেলে স্বামী, শ্বাশুড়ি, ননদ ও দেবর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এলাকার লোকজন ননদকে বেঁধে রাখেন। আর স্বামী বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে সুমিকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসক জানালেন সুমি অনেক আগেই মারা গেছেন। কখনো একটি মোবাইল ফোন পেলেন না হতভাগ্য সুমি।
শেষে কিনা মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে খোদ স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করলেন। পূর্বাচলের রূপগঞ্জ থানার বাড়িয়ারটেক সরকার বাড়িতে এই ঘটনা ঘটে। সুমিকে হত্যার এমন লোকহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তার ভাই মো. বাপ্পী মিয়া। বুধবার (৭ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত ‘সুমি হত্যার বিচারের দাবিতে’ আয়োজিত মানববন্ধনে সুমির ভাই বাপ্পী তার বোনকে হত্যার বর্ণনা দেন।
বাপ্পী মিয়া বলেন, আমার মা-বাবা গরীব। আর প্রবাসী আবদুল আউয়াল প্রভাবশালী। বিয়ের পর থেকে কখনো যৌতুকের জন্য, কখনো অপবাদ দিয়ে আমার বোনকে আউয়াল ও তার পরিবারের লোকজন (শ্বাশুড়ি, ননদ ও দেবর) শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। তাদের ঘরে তিনটি ছেলে সন্তান রয়েছে (একজন ৭ বছর, একজন ৫ বছর ও অপরজন ১১ মাস)। আমার গরীব হওয়ায় আর তিনটি সন্তানের মুখে দিকে তাকিয়ে সুমি সকল অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করে সংসার করেছেন। আমার বোনকে আউয়াল কখনো একটি বাটন ফোনও দেননি। অথচ অনেক আত্মীয়-স্বজনকে বিদেশ থেকে আনা দামি দামি জিনিস দিতেন আউয়াল। আউয়াল আসলে তার মা, বোন ও ভাইয়ের সহায়তায় প্রচুর মারধর করতো সুমিকে। তাদের বাড়ির পাশের লোকজন আমাদের সব বলতো। আমরা প্রতিবাদ করলে আউয়াল ও তার ভাই শফিকুল মিয়া (জমির দালালি) টাকার বিনিময়ে আমার বোন ও আমাদের পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন। একমাস আগে আউয়াল দেশে এসেছেন। কয়েকটি মোবাইল এনেছেন আত্মীয়দের জন্য। আমার বোন কখনো তার কাছে মোবাইল চায়নি, চেয়েছে সুখ। ২৪ মার্চ সকালে আমার বোনের সঙ্গে আউয়ালের কথা কাটাকাটি হয়। মোবাইল চুরির অপবাদ দেয় সুমিকে।
সুমি প্রতিবাদ করলে আউয়াল তার মা, বোন ও ভাইয়ের সহায়তায় সুমিকে কয়েক দফা বেধড়ক মারধর করেন। সুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে রুমে রেখে আউয়াল নামাজ পড়তে যায়। এর মধ্যে পাহারায় থাকে শ্বাশুড়ি, ননদ ও দেবর। আউয়াল নামাজ থেকে এসে দেখে সুমি মারা গেছে। তখন আউয়াল তার মা, বোন ও ভাইয়ের সহায়তায় সুমিকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুঁলিয়ে রাখে। এর মধ্যে বাড়ির আশপাশের লোকজন টের পেয়ে যায়। লোকজনের তোপের মুখে দেবর পালিয়ে গেলেও ননদকে লোকজন বেঁধে ও শ্বাশুড়িকে আটকে রাখে। আর আউয়াল দ্রুত সুমিকে রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক বলে কয়েক ঘণ্টা আগেই সুমি মারা গেছে। এসময় আউয়াল বেশ কিছু লোকজনকে ফোন করে হাসপাতালে জড়ো করে। হাসপাতাল থেকে সুমিকে দ্রুত নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আউয়াল। পরে আমরা এলাকাবাসীর সহায়তায় আউয়ালকে আটক করে তার বোন ও মাসহ পুলিশে দেয়। কিন্তু দেবর শফিকুল মিয়া পালিয়ে যায়।
বাপ্পী মিয়ার অভিযোগ করে বলেন, আমরা হত্যা মামলা করতে চাইলেও রূপগঞ্জ থানা পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। উল্টো স্থানীয় প্রভাবশালী ও নামধারী কয়েকজন রাজনীতিবিদের সহায়তায় রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী আমাদের হুমকি দেয়। ওসি ও প্রভাবশালীদের অনেক টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে স্বামী আবদুল আউয়াল। ওসি বলেন, হত্যা মামলা নেয়া যাবে না। আপনারা দু’পক্ষ বসে কিছু টাকা নিয়ে মিটমাট করে ফেলেন। আমরা হত্যা মামলা করার জন্য লিখে নিয়ে গেছি। কিন্তু ওসির কথায় রাজি আমাদের মামলা নেয়নি। হত্যার পরদিন রাত ১২টার পর ওসি নিজে ‘আত্মহত্যা’ করেছে বলে মামলা লিখে নিয়ে আমার মাকে সই করতে বলেন। পুলিশ স্বামী আবদুল আউয়াল, তার মা জাহেরা বেগম ও বোন সরু আক্তার গ্রেফতার করেছেন। বোন ও মা ইতোমধ্যে হাইকোর্ট থেকে জামিনে বের হয়েছেন।
তবে আউয়াল জেলে রয়েছেন। তিনজনকে আটকের সময় বাড়ির আশপাশের লোকজন ও স্থানীয়রা ‘সুমিকে পিটিয়ে হত্যা’ করা হয়েছে বলে স্বাক্ষী দিয়েছেন। ২৫ মার্চ রাতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার তদন্ত করছেন রূপগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর। দেড়মাস পার হলেও তদন্ত কর্মকর্তা একদিনের জন্যও তদন্ত করতে আসেননি। এমনকি পুলিশ সুরুতহাল রিপোর্টও দিচ্ছেন না। মামলার আসামী সুমির দেবর শফিকুল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাকে গ্রেফতার করছে না। শফিকুল নিজে ও এলাকার খারাপ প্রকৃতির লোকজন দিয়ে আমি ও আমার পরিবারের লোকজনকে প্রকাশ্যে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন। এছাড়া আউয়ালকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে জামিন করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আউয়াল জামিনে বের হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাবে বলেও তার ভাই আমাদের জানিয়েছেন। আর সুমি হত্যার বিচার কখনো হবে না বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সুমি হত্যার সুষ্ঠ বিচার করতে আউয়ালের মা, বোন ও দেবরকে গ্রেফতার করে স্বামীসহ রিমান্ডে নিতে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে ন্যায় বিচারের স্বার্থে আউয়াল যেন জামিন নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করছি।
মানববন্ধনে সুমির মা, বাবাসহ আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির যুগ্ম মহাসচিব উপাধ্যক্ষ নূরুজ্জামান হীরা, সবুজ আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক মুরসালিন বাবু, লেবার পার্টির মহাসচিব আল মামুনসহ স্থানীয় লোকজন ও একটি মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবাই ব্যানার ও প্লেকার্ড হাতে সুমি হত্যার বিচার দাবি করেন।