সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ০১:৫৬ পূর্বাহ্ন

বিএনপি-এনসিপি: দলীয় শাস্তি কতটা কার্যকর, কতটা লোক দেখানো?

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ রবিবার, ৬ জুলাই, ২০২৫
  • ১৪ প্রদর্শন করেছেন

বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। বিতর্কিত মন্তব্য আর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এনসিপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও। সব দলের নেতাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ‘প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা’বলা হয়, নানা সময়ে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে শোকজ-বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে।

কিন্তু তারপরে কী ঘটে? চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসাবে তাদের সঙ্গে কি দল সম্পর্ক ছিন্ন করে, নাকি ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেলে আবার তারা দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়ে ওঠেন? খবর ডয়চে ভেলে।

ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, দাবি বিএনপির

বিএনপির যাদের বিরুদ্ধে ব্যস্থা নেওয়া হয়েছে বলছে তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই দখল, সংঘাত আর চাঁদাবাজির অভিযোগ। ধর্ষণের অভিযোগও আছে। সর্বশেষ গত ২৯ জুন ভোলায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে বিএনপির সহযোগী সংগঠন শ্রমিক দল, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীসহ সাত জনের বিরুদ্ধে। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় শ্রমিকদল ও ছাত্রদলের তিনজনকে বহিস্কার করা হয়েছে দল থেকে।

কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বাস্তবে যে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না তা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভীর কথাতেই স্পষ্ট। শুক্রবার (৪ জুন) এক সংবাদ সম্মেলনে তার আগের ২৪ ঘণ্টায় দলীয় ব্যবস্থা নেয়ার একটি হিসাব দিয়েছেন তিনি।

রিজভী বলেন, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে মশাল মিছিল, ভাঙচুর, নিজ দলের কর্মীদের আঘাত করা ইত্যাদি ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানতে পেরে তদন্ত করে চিলমারী উপজেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক সাঈদ হোসেন পাখি ও সদস্য আবদুল মতির শিরিনের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছি।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার কোতোয়ালী মডেল থানার পাছথুবী ইউনিয়নের (দক্ষিণ) সাধারণ সম্পাদক খোকন মিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কারণ দলের নামে ‘বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও অস্ত্রবাজির’সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার সেসব ছবিও পাওয়া গেছে।

বহিষ্কার করা হয়েছে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হাওলাদারকে। কয়েকজন দুস্কৃতকারীকে সাথে নিয়ে তিনি চাঁচড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতিকে মারধর করেছেন। রিজভী বলেন, ‘এটা কতবড় অনৈতিক কাপুরুষোচিত কাজ, তাকে (খোকন মিয়া) আজ সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করা হয়েছে’।

লালমনিরহাটের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পাটগ্রামে এই ধরনের ঘটনা শোনা গেছে যে কিছু লোক বিএনপির নামে সেখানকার থানায় ঢুকে ভাঙচুর করেছে এবং দুইজনকে ছিনিয়ে আনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে, এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে’।

ঢাকার মহাখালীর জাকারিয়া বারে ঢুকে ভাঙচুর ও নারীদের ওপর হামলার ছবি ও ভিডিও স্যোশাল মিডিয়ায় এসেছে। বনানী থানা যুবদলের আহ্বায়ক মুনির হোসেনের নেতৃত্বে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। রিজভী বলেন, এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী যুবদল তাক্ষণিকভাবে যুবদলের নামধারী এই নেতাকে যুবদল থেকে বহিষ্কার করেছে।

এর আগেও বিএনপি নিয়মিতই বিভিন্ন ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য জানিয়েছে। কিন্তু তারপরেও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকেরা। এসব ব্যবস্থার কতটা আসলে কার্যকর হয়, সেটি নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

ধীরে ধীরে প্রত্যাহার হচ্ছে বহিষ্কারাদেশ

বিএনপি যেসব ব্যবস্থা নেয় তার মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি হলো দল থেকে বহিস্কার। এর আগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়, সদস্যপদ স্থগিত রাখা হয়।

বিএনপির দপ্তর থেকে ডয়চে ভেলে’কে জানানো হয়েছে, এই ধরনের ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় তিন হাজার ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মী রয়েছেন এক হাজার ৮০০ জন। এদের মধ্যে ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

ছাত্রদল এখন পর্যন্ত  ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ছয় শতাকির নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ নেতাকর্মী বহিষ্কার ও ১৫০ জন কারণ দর্শানো নোটিশ পেয়েছেন, যুবদলেরও শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তবে অভিযোগ রয়েছে, কাগজে-কলমে বহিস্কারের পরও অনেকেরই দাপট কমেনি। বিএনপি যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তাদের কেউ কেউ আবার দলে ফিরছেন। তাদের আবেদনের ভিত্তিতে বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারও করা হচ্ছে।

গত বছরের ২১ আগস্ট ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছিলো। ১০ নভেম্বর তাদের সদস্যপদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয় ।

প্রত্যাহারের চিঠিতে বলা হয়, গত ২১ আগস্ট ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তাদের বিএনপির সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছিল। নির্দেশক্রমে সব পদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হলো। এতে আরও বলা হয়, ওই ঘটনার মতো কোনো সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় এবং এখন থেকে দলের নীতি, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান হবেন বলে দল আশা রাখে।

এই ঘটনায় নিহত কবির ভূঁইয়ার স্ত্রী মোনজিলা বেগম ২৪ আগস্ট নগরকান্দা থানায় বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাত হিসেবে আরো ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিবাদীর তালিকায় শামা ওবায়েদের নাম রয়েছে এক নম্বরে।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় মীর পাল্প অ্যান্ড পেপার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড থেকে গত বছরের ২৯ আগস্ট বেশ কয়েকটি দামি গাড়ি রাতের আঁধারে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় ছিল এই গাড়িগুলো।

এ ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া তদারকি করছেন বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এবং কর্ণফুলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক এসএম মামুন মিয়াকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। পরবর্তীতে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সব পর্যায়ের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়।

কিন্তু চার মাস যেতে না যেতেই ২৫ ডিসেম্বর তাদের তিনজনেরই প্রাথমিক সদস্যপদ আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপি জানিয়েছে, অভিযুক্তদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের সতর্ক করে প্রাথমিক সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চাঁদাবাজি ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী জাহাঙ্গীর পাটোয়ারীকে মার্চে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায় থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই অভিযোগে একই দিনে ঢাকা মহানগর উত্তরের পল্লবী থানার ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি এস এম গোলাম মোস্তফা মাষ্টারকেও দলীয় সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এক মাস পর ১৭ এপ্রিল তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দুই জনেরই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি।

চাঁদাবাজির অভিযোগে ৫ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু নাছেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাও হয়। তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে বিএনপির সময় লেগেছে এক সপ্তাহ। ১৩ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের চিঠিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নোয়াখালী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও নোয়াখালী জেলা বিএনপি’র সাবেক কোষাধ্যক্ষ আবু নাছের-কে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। নির্দেশক্রমে সেই বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বিএনপি ঢাকা মহানগর উত্তরের আদাবর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মাসুম বাবুলের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয় ৩ ফেব্রুয়ারি। চাঁদাবাজি, দলীয় নীতি, আদর্শ ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

২৩ জানুয়ারি প্রত্যাহার করা হয় বিএনপির তিন নেত্রীর বহিস্কারাদেশ। তারা হলেন, পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি জাহানারা বেগম, বান্দরবান জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য হামিদা চৌধুরী এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি খালেদা সিদ্দিকী স্বপ্না। দলীয় নীতি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিলো।

এপ্রিলে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা, পৌর ও ওয়ার্ড যুবদলের বহিষ্কৃত সাত নেতার বহিষ্কার করার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই প্রত্যাহার করা হয়। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বেলকুচি উপজেলা যুবদলের সাবেক সদস্য পল্টন জোরদার, পৌর যুবদলের সাবেক সদস্য উজ্জ্বল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক মো. কাইয়ুম, ২নং ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি চাইনিজ রফিকুল, সাবেক সদস্য হাবিব ওরফে হাবলু, সেলিফ আল আকবার শশী এবং দৌলতপুর ইউনিয়নের হাফিজুল ইসলামকে ১৬ এপ্রিল সকালে বহিষ্কার করা হয়। ওই দিন রাতেই তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে জেলা যুবদল। প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়ে, সাংগঠনিক কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে ও পরিস্থিতি, মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রত্যাহার হওয়া নেতাদের দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জিরো টলারেন্স নীতি বনাম তৃণমূলের বাস্তবতা

বহিষ্কৃত নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ দ্রুতই পদপদবী ফিরে পাচ্ছেন, রাজনীতিতেও সক্রিয় আছেন। কিন্তু রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, বিএনপি এবং এর নেতারা ‘আপসহীন’ এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘একেবারে জিরো টলারেন্স’ নীতিতে আছেন।

বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য বাস্তব চিত্রের বেশ ফারাক রয়েছে। ‘একেবারে জিরো টলারেন্স’ নীতিতেও অনেকে আবার দলে ফিরছেন, সংঘর্ষ-সংঘাতও দেশজুড়েই চলছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই এসব তথ্য উঠে আসছে।

দেশের কয়েকটি এলাকায় কথা বলে জানা গেছে যাদের বিরুদ্ধে এই পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের দাপট কমছে না। যাদের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে তারা দ্বিগুণ উদ্যোগে মাঠে নেমেছেন। চট্টগ্রামে বহিস্কৃত হয়ে যারা আবার দলে ফিরেছেন তারাই দাপটের সঙ্গে আছেন বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। বরিশালে বহিস্কৃত এক নেত্রী এখানো তার নিয়ন্ত্রণ সেখানে বজায় রেখেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা। নাটোরের বড়াই গ্রাম, গাজীপুর, পাবনা ও মানিকগঞ্জ থেকেও পাওয়া গেছে একই তথ্য।

দলের মধ্যে সাংগঠনিক অবস্থান নিয়ে বিপদে পড়ার আশঙ্কায় অনেক নেতাকর্মীই নিজেদের নাম ও পদবী প্রকাশ করে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতা কথা বলেছেন।

ভোলার এক বিএনপি নেতা ডয়চে ভেলে’কে বলেছেন, আসলে বিএনপির ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। দখলদার ও চাঁদাবাজরাই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে।

বাগেরহাটের এক বিএনপি নেতাও এক ধরনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন,  যারা দখল ও চাঁদাবাহিসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত, তাদের বহিষ্কার করলেও তাদের আধিপত্য কমছে না।

এ বিষয়ে বিএনপির বক্তব্য ও অবস্থান জানতে চাইলে দলটির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, আসলে ঠিক কতজনকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে সেই হিসাব আমার কাছে নেই। তবে কারুর কারুর শাস্তি প্রতাহার করে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যারা সংশোধন হচ্ছেন, সঠিক পথে ফিরে আসছেন, তারা বহিষ্কৃত হলেও তাদের আবার দলে ফিরে আসার সুযোগ আছে। তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে  দলের কাছে আবেদনও করতে পারেন।

তিনি বলেন, তবে গুরুতর অপরাধ যারা করছেন তারা আর ফিরে আসতে পারছেন না। যাদের অপরাধ কম বা লঘু তারা এই সুযোগ পাচ্ছেন।

কিন্তু এখনও সদস্যপদ স্থগিত বা বহিষ্কারাদেশ থাকা নেতাকর্মীরাও কিভাবে রাজনীতির মাঠে দাপট দেখাচ্ছেন?এই প্রশ্নের জবাবে তাইফুল ইসলাম বলেন, কাউকে বহিষ্কার বা কারুর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেই যে তিনি দলের কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন না বা দলের কাজ করতে পারবেন না, তা নয়। আসলে তারা দলের পদ-পদবী ব্যবহার করতে পারেন না। যারা বহিষ্কার হন, তাদেরও তো ইচ্ছা থাকে সংশোধন হলে দলে আবার ফিরে আসার।

তবে যাদের সাংগঠনিক শাস্তিপ্রাপ্তদের আবার দলে ফিরিয়ে আনা খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান।

তিনি বলেন, দলে ফেরত নেওয়া তো উচিতই নয়। আমি মনে করি কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন, পাটগ্রামে থানায় হামলা-এই ধরনের ঘটনায় শুধু আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান নয়, কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো তাও বিএনপির পারস্যু করা উচিত। আর শুধু মাত্র, যে অপরাধের অভিযোগে কাউকে বহিষ্কার করা হয়, সেই অপরাধ যদি সত্যিই সে না করে থাকে তাহলে তাকে দলে ফেরত নেওয়া যায়। আর কোনো কারণে নয়। তা না হলে ওই সব ব্যবস্থা আইওয়াশে পরিণত হয়।

কারণ দর্শানোতেই সীমাবদ্ধ এনসিপি

২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করে। এর পর চার মাসে চার জন কেন্দ্রীয় নেতাকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগে শোকজ নোটিশ দিয়েছে দলটি। তারা হলেন, গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর, আবদুল হান্নান মাসউদ, জোবাইরুল ইসলাম মানিক ও সরোয়ার তুষার। এর বাইরে রাজশাহীর এক নেতা নাহিদুল ইসলামকে দল থেকে সামায়িকভাবে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছে।

২০ মে রাতে ধানমন্ডির চার নাম্বার সড়কে মব তৈরি করে হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টার অভিযোগে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। পরে এনসিপি নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ তাদের মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে তাকে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। জবাবে ভুল স্বীকার করেন এবং আগামীতে এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না মর্মে অঙ্গীকার করেন তিনি। এরপর তার কারণ দর্শানো নোটিশ প্রত্যাহার করে নেয় এনসিপি।

বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য জোবাইরুল ইসলাম মানিক। চট্টগ্রামে এক বক্তব্যে তিনি বলেন,বিগত ১৬ বছরে একজন মাফিয়াকে হটাতে পারছি। আমাদের বুঝ দিয়ে আবার যদি কেউ মাফিয়া হতে চায়, তাদের বলবো আমাদের চেয়ে বড় মাফিয়া নেই। এ নিয়েও সমালোচনার মুখে ১০ জুন তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি সতর্কবার্তা জারি করে এনসিপি।

এপ্রিলে যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং এনসিটিবির পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। গত মে মাসে দৈনিক জনকণ্ঠ কার্যালয়ে এক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দলের যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশিরের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে সতর্কবার্তা জারি করে এনসিপি। নিজের দলের এক কেন্দ্রীয় নারী সহকর্মীকে টেলিফোনে আপত্তিকর কথা বলায় শোকজ করা হয় যুগ্ম সদস্যসচিব সারওয়ার তুষারকেও।

২৭ জুন এনসিপির রাজশাহী জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলাম ওরফে সাজুকে ‘গুরুতর’ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কেন তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। তিনি দলের আরেক নেতাকে মারধর করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, আমরা কাউকেই দল থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করিনি। আমাদের শৃঙ্খলা কমিটি আছে। তারা অভিযোগের তদন্ত করছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে দল তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

তিনি বলেন, আমাদের দলটি নতুন। আমাদের দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা তৎপর আছি।

বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি, মব তৈরি সহ নানা অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে মনিরা শারমিন বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি আলাদা ও স্বতন্ত্র সংগঠন। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই। তাদের কাজের দায় আমরা নেব না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, এনসিপি যে বৈষম্যবিরোধীদের দায় নেবে না এটা একটা উদ্ভট কথা। বৈষম্যবিরোধীদের পটিয়া থানা আক্রমণ নিয়ে তো তাদের পক্ষে এনসিপি নেতারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। তাই দায় নেবেন না এটা তারা বলতে পারেন না। আর এনসিপির যে কয়েকজন নেতাকে দল থেকে শোকজ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু তারা চূড়ান্ত কোনো ব্যবস্থা নেননি এখনো। ফলে এটা দায়সারা গোছের  ব্যবস্থা বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ