দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। চিকিৎসক ও অফিস কর্তারা মিলে ৫ বছরে এসব টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নীপাসহ সাবেক বড় বাবু হাসান আর বর্তমানে স্টোর কিপার কাম বড় বাবু হুমায়ুন কবীর মিলে এসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে অপারেশ না হলেও কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে গেল পাঁচ বছরে সহস্রাধিক অপারেশন করেছেন ডাক্তাররা। ফলে ওটি বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে এক কোটিরও বেশি টাকা। গেল পাঁচ বছরে অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি মেরামত বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ২১ লাখ টাকা। আর সার্জিক্যাল মালামাল ক্রয় করা হয়েছে ৭৯ লাখ টাকার। যেখানে অপারেশনই হয় না, সেখানে এক কোটি টাকার ওপরে ব্যয় দেখানো হয়েছে। সচেতন মহলের প্রশ্ন সেসব মালামাল গেল কোথায়? এছাড়া গত ৫ বছরে দামুড়হুদা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধ এবং অন্যান্য মালামাল কেনা হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকার। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, হাসপাতলের বরাদ্দ অনুযায়ী বছরে গড়ে ২০ লাখ টাকা এসেছে ওটির যন্ত্রপাতি মেরামত ও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনী মালামাল কেনার জন্য। কিন্তু হাসপাতাল রেজিস্ট্রারের তথ্যের সঙ্গে বাস্তব তথ্যের কোনো মিল নেই। অভিযোগকারীরা জানান, লাখ লাখ টাকার ওষুধ এখানে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা সাধারণ রোগীরা পাননি। ওষুধের সিংহভাগ চলে গেছে প্রাইভেট ক্লিনিকে। হাসপাতালের সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর অসংখ্য রোগীর অপারেশন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ৬১টি বড় এবং এক হাজার ৯১৯টি ছোট অপারেশন দেখানো হয়েছে। তবে ওটি রেজিস্ট্রারে ৫ বছরে মাত্র অর্ধশত অপারেশনের তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। হাসপাতালের অপারেশনের বিষয়ে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ মোহাম্মদ শাহজাহান আলী জানান, হাসপাতালে কোনো অপারেশনই হয় না। যে হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়, সেটি স্কোর বাড়ানোর জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। এদিকে, ওষুধ কেলেঙ্কারির মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হাসপাতালটিতে ঠান্ডাজনিত রোগের ওষুধ মন্টিলুকাস-১০ ট্যাবলেট সাড়ে ৪৬ হাজার পিস বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার প্রতি পিসের মূল্য ১৬ দশমিক ৯৯১ টাকা। ওষুধের বাজারমূল্য প্রায় ৮ লাখ টাকা। কিন্তু সে ওষধ পাননি রোগীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নীপা জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চাহিদা অনুযায়ী ঠান্ডাজনিত রোগের ওধু মন্টিলুকাস ট্যাবলেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর বাকি ট্যাবলেট ইউনিয়ন সাব-সেন্টারগুলোতে বিতরণ করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাব-সেন্টারের দায়িত্ব প্রাপ্তরা জানান ভিন্ন কথা।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ফার্মাসিস্ট ফারুক হাসান রেজিস্ট্রার ঘেটে জানান, গত দুই বছরে মন্টিলুকাস ট্যাবলেট তিনি পাননি। সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হাসপাতালটিতে ২০জি ও ২২জি সাইজের আইভি ক্যানোলা কেনা হয় ২০ হাজার। যার প্রতি পিসের মূল্য ৩৭ দশমিক ৯৯১ টাকা। ২০ হাজার ক্যানোলার মূল্য প্রায় ৮ লাখ টাকা। অথচ কেনা হয়েছে ১৮জি ক্যানোলা। ১৮জি ক্যানোলার প্রতিটির মূল্য ২০ টাকা করে। অর্থাৎ বাজেটের অর্ধেক টাকা গেছে কর্মকর্তদের পকেটে। আর সে ক্যানোলা এখন কোনো কাজেই আসছে না রোগীদের। তাদেরকে বাধ্য হয়েই বাইরে থেকে ক্যানোলা কিনতে হচ্ছে। মাইক্রোপোর টেপ কেনায়েও হয়েছে দুর্নীতি। সিডিউল অনুযায়ী তা কেনা হয়নি। দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফাহানা ওয়াহিদ তানি জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেসথেশিয়া চিকিৎসক না থাকায় অপারেশন বন্ধ রয়েছে। তিনি আরও জানান, বিগত ৫ বছর আগে আমি এখানে জয়েন করার পরে কয়েকটি অপারেশন হয়েছে। যে অপারেশনগুলো আমিই করেছি। আমি যেহেতু গাইনিতে এফসিপিএস ডিগ্রিধারী। সে কারণে অপারেশনগুলো হয়েছে। অথচ ৫ বছরে কোনো অপারেশন না হলেও প্রতিবছর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশন থিয়েটারে বিভিন্ন জিনিসপত্র মেরামত বাবদ আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান সুতা, স্পাইনাল নিডিল নিমিষেই গায়েব করা হয়েছে। কথিত রয়েছে সেসব সুতা ও ওষুধ গিয়েছে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নীপার জীবননগরে অবস্থিত কেয়ার সনো নার্সিং হোমে। শুধু এখানেই শেষ নয়, আয়া-সুইপারদের বেতনের একটি অংশ যায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নীপা ও স্টোরকিপার কাম বড় বাবু হুমায়ুন কবিরের পকেটে। আছে, ভেষজ বাগানের জন্য বরাদ্দের ৩ লাখ টাকা হজমের অভিযোগও। নথি বলছে, আয়ার দৈনিক মজুরি ৪৫০ আর ও সুইপারের ৫০০ টাকা কিন্তু মাসে আয়া বেতন পান মাত্র ২ হাজার আর সুইপার সাড়ে ৬ হাজার টাকা। বাকিটা যাচ্ছে কর্মকর্তাদের পকেটে। হাসপাতালের বেড শিট, বালিশের কাভার, ম্যাট্রেস, কম্বলসহ নানা প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটাতেও হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। এত সব অভিযোগের তীর ডাক্তার হেলেনা আক্তার নীপার দিকে। এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়াউদ্দীন অহমেদ বলেন, ওটি রেজিস্ট্রার মেইনটেইন করেই অপারেশনের তালিকা লিপিবদ্ধ করতে হয়। সে অনুযায়ী তাদেরকে রিপোর্ট প্রদান করতে হবে। এটার ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৃতভাবে যেগুলো অপারেশন করা হবে তাইই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠাতে হবে। অপারেশন না করে স্কোর বাড়ানোর জন্য অতিরিক্তি অপারেশন দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তদন্ত রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।