রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৯ অপরাহ্ন

ব্রিটেনে নতুন অভিবাসন নীতি, অনিশ্চিত অপেক্ষায় ১৭ লাখ অভিবাসী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • প্রকাশের সময়ঃ রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৩ প্রদর্শন করেছেন

স্মরণকালের অন্যতম কঠোর আবাসন নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। নতুন নীতি কার্যকর হলে দেশটিতে স্থায়ী বসবাসের অনুমতির অপেক্ষায় থাকা প্রায় ১৭ লাখ বৈধ অভিবাসী অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়বেন। পাশাপাশি আশ্রয়ের আবেদন প্রক্রিয়াধীন থাকা আরও অন্তত ১০ লাখ অভিবাসীও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদের ঘোষিত নতুন ‘সেটেলমেন্ট’ নীতিমালার কারণে শিশুরাও এবার বাদ থাকছে না। ঘোষণার পর থেকেই অভিবাসী কমিউনিটি, মানবাধিকার সংস্থা ও রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে।

ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক পলিসি রিসার্চ (আইপিপিআর)–এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ যুক্তরাজ্যে ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন বা প্রায় ১৭ লাখ মানুষ এমন ভিসায় ছিলেন, যা সরাসরি ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন (আইএলআর) বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেয়।

নতুন নীতিতে তাদের বসবাসের যোগ্যতার সময়সীমা হঠাৎ করে দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানো হলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের আইএলআর পাওয়ার পথ দীর্ঘ অনিশ্চয়তায় ফেলতে পারে। এদের মধ্যে ১২ . ৯ লাখ কর্মী ভিসাধারী, ১ দশমিক ৬ লাখ শরণার্থী ও সুরক্ষা–প্রাপ্ত ব্যক্তি, ১ দশমিক ৮৩ লাখ হংকংয়ের ব্রিটিশ ন্যাশনাল (ওভারসিজ) ভিসাধারী এবং আরও প্রায় ৩০ হাজার অন্য রুটের মানুষ রয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১৬ দশমিক ৬ লাখ মানুষ ২০২৪ সালের শেষভাগে ‘রুট টু সেটেলমেন্ট’ এ ছিলেন, যারা এখন ৫ বছরের বদলে ১০ থেকে ২০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি নিয়মে ২০২৬ সালেই প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার অভিবাসী পাঁচ বছর পূর্ণ করে আইএলআর-এর জন্য যোগ্য হতেন। নতুন আইন কার্যকর হলে তাদের আরও পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে। একইভাবে ২০২৮ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বছরে ৬ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে । ফলে প্রতিবছরই আরও বড় একটি গ্রুপ স্থায়ী বসবাসের দোরগোড়ায় পৌঁছে আবার দীর্ঘ রুটে আটকে যেতে পারে।

২০ নভেম্বর হাউস অব কমনস-এ দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নতুন নীতির মূল দর্শন হলো, স্থায়ী বসবাস আর ‘অধিকার’ নয়, বরং ‘অর্জিত যোগ্যতা’।

প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী, অধিকাংশ রুটে আইএলআর এর জন্য সময় ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করা হবে। যেসব অভিবাসী “হাই-কন্ট্রিবিউটিং” বা উচ্চ অবদানকারী হিসাবে ধরা হবে। তারা হলে- উচ্চ আয়, উন্নত ইংরেজি দক্ষতা, স্বেচ্ছাসেবী কাজ বা জরুরি সেবাখাতে নিয়োজিত তাদের জন্য ৩ বা ৫ বছরের ফাস্টুট্র্যাক রুট রাখা হয়েছে। বিপরীতে, যারা এক বছরের বেশি সময় সরকারের বেনিফিট নেবেন, অপরাধে জড়াবেন বা অবৈধ পথে দেশে প্রবেশ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে অপেক্ষা–সময় ২০ থেকে ৩০ বছরে গড়াতে পারে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২১ সালের পর যারা যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছেন, তাদের ওপর এই নীতি প্রযোজ্য হবে।

হোম অফিস (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার ৮০০ জনকে আইএলআর দিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় একুতৃতীয়াংশ বেশি। পুরোনো নিয়ম চালু থাকলে ২০২৬ সাল নাগাদ আরও ১৭ লাখ মানুষ আইএলআর পেতেন। এতে আবাসন, সুরক্ষা তহবিল ও জনসেবার ওপর গুরুতর চাপ তৈরি হবে। সরকারের দাবি, স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পর অনেক অভিবাসী কাজ কমিয়ে দেন বা বেনিফিটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, এতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ে। তাই কন্ট্রিবিউশনভিত্তিক নতুন মডেল জরুরি।

নতুন নীতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে স্বাস্থ্য খাত ও কেয়ার সেক্টরে। বর্তমানে এনএইচএসএ কর্মরত অন্তত ৫০ হাজার বিদেশি নার্স এই নীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাদের অভিযোগ, আইএলআর পেতে সময় দ্বিগুণ হলে পরিবার নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। বেনিফিট বা সামাজিক বাসস্থানে প্রবেশাধিকার পিছিয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কঠিন হয়ে উঠবে। আর জটিল কাগজপত্র ও উচ্চ ফি অনেককে যুক্তরাজ্য ছাড়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

শিশুদের ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনছে সরকার। বর্তমানে কোনো শিশু যুক্তরাজ্যে ৭ বছর কাটালে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের বাবা-মা বৈধ হোক বা অবৈধ হোক। এর মাধ্যমে শিশু অধিকারের কারণে বাবা-মাও যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি পেতো। কিন্তু নতুন নিয়ম অনুযায়ী এই সুযোগ আর থাকবে না। বাবা-মা অবৈধ হলে শিশুকেও তৃতীয় কোনো দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। আগে পরিবারকে বিভক্ত না করা ও শিশুদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নীতি ছিল। এখন পরিবারসহ শিশুদেরও বহিষ্কারের অধীন রাখা হবে।

এ নিয়ে হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড ডাবস কড়া সমালোচনা (গার্ডিয়ান) করে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার্যত শিশুদের ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি এটিকে নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন।

এদিকে লেবার পার্টির ভেতরে নীতিটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এমপি টনি ভন বলেন, যেসব শরণার্থীকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাদের ফেরত পাঠানোর চিন্তাটাই ভুল। এদের সমাজে একীভূত করা উচিত, স্থায়ী অনিশ্চয়তায় ফেলে রাখা নয়। এমপি নাদিয়া হুইটোম বলেন, যারা ভয়াবহ নির্যাতন ও বিপদ থেকে পালিয়ে এসেছে, তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া লেবার সরকারের কাজ হওয়া লজ্জাজনক। সংসদ সদস্য স্টেলা ক্রিসি মনে করেন, সিদ্ধান্তটি শুধু নিষ্ঠুরই নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবেও পুরোপুরি ভুল। এমপি কিম জনসন বলেন, এটি লেবার দলের নীতির পরিপন্থী এবং সরাসরি চরম-ডানপন্থি রাজনীতির কপি।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কার্যত একটি ‘রেট্রোস্পেকটিভ’ আইন। অর্থাৎ নতুন নিয়মকে অতীতের বৈধ বসবাসকারীদের ওপর আরোপ করা। যা গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণত অন্যায় ও আইনি। তাদের মতে, এই নীতি বাস্তবায়ন সহজ হবে না; সংসদে দীর্ঘ বিতর্ক, জনমত যাচাই এবং আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। যে কারণে লেবার সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা অতো সহজ হবে না।

কেয়ার ভিসায় পরিবারসহ বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে আসা মাসুম হোসাইন শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ৫ বছর পর স্থায়ী বসবাসের অনুমত পাওয়ার আশায় যুক্তরাজ্যে এসেছি। এ জন্য অনেক টাকাও খরচ হয়েছে। তাছাড়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কর্মঘণ্টাও দিতে পারছে না। তার পরেও আশায় ছিলাম ২০২৭ সালে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাবার। কিন্তু সরকারের হঠাৎ এমন ঘোষণা আমাদেরকে অনিশ্চিয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

তবে সরকারের দাবি, উচ্চ অভিবাসন চাপ, আবাসন সংকট ও জনসেবার ওপর বোঝা মোকাবিলার জন্য এই পরিবর্তন সময়োপযোগী। তারা বলছে, যারা নিয়ম মেনে কাজ করছে, ট্যাক্স দিচ্ছে এবং সমাজে অবদান রাখছে তাদের জন্য দ্রুত রুট। আর অবৈধ বা কম অবদানকারীদের জন্য কঠোরতা। এটাই নতুন মডেলের মূল উদ্দেশ্য।

তবে ইইউ সেটেলমেন্ট স্কিমধারীরা, ব্রিটিশ সিটিজেনদের স্পাউজ বা ডিপেন্ডন্ট এবং তাদের সন্তান ও পিতামাতারা এই নতুন নীতির আওতার বাইরে থাকবেন। হোম অফিস জানায়, ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ইইউ স্কিমে ৮৪ লাখ আবেদন জমা পড়ে। যার মধ্যে ৫৭ লাখ স্ট্যাটাস পেয়েছেন। বিদ্যমান নিয়মেই তারা ৫ বছরে ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

লন্ডনে ইমিগ্রেশন আইন বিশেষজ্ঞ ও কিংডম সলিসিটার্সের প্রিন্সিপ্যাল ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী বলেন, ‘প্রথমত আইনটি এখনো হয়নি। এটি একটি মাত্র পরিকল্পনা। এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা-বিতর্ক হবে। এখনই চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এটি একটি আগাম আভাস। অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কে এটি পাস নাও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সংক্ষুবদ্ধরা মামলাও করতে পারেন।’

নতুন এ আইনের পক্ষে-বিপক্ষে সরকার এরই মধ্যে জনমত গ্রহণ শুরু করেছে। ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে যে কেউ তাদের  মতামত প্রকাশ করতে পারবেন।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ