এক দশকের হিসাবে ২০২৩ সালকে অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। বছরটিতে সারা বিশ্বের অভিবাসন রুটে মারা গেছে অন্তত আট হাজার ৫৬৫ জন অভিবাসী। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে বুধবার ২০২৩ সালকে অভিবাসন ইস্যুতে ভয়াবহ বছর হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তারা। জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘২০২৩ সালে অভিবাসন রুটে অভিবাসীদের মৃত্যুর হার তার আগের বছরের তুলনায় অন্তত ২০ ভাগ বেড়েছে। অভিবাসন রুটে প্রাণহানি ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। ২০২৩ সালে অভিবাসন রুটে অভিবাসী মৃত্যুর সংখ্যার ২০১৬ সালের রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গেছে। আইওএম জানিয়েছে, ২০১৬ সালে অভিবাসন রুটে মারা গেছে আট হাজার ৮৪ জন। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাস শেষ না হতেই অভিবাসন রুটে ৫১২ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। আইওএম বলেছে, নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসনের পথ সীমিত থাকার কারণে প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে অনিয়মিত পথে অভিবাসনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। অভিবাসন রুটের মধ্যে সবচেয়ে মারত্মক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ভূমধ্যসাগরকে। উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া ও তিউনিশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ইউরোপের দক্ষিণে পৌঁছনোর চেষ্টা করে। ২০২৩ সালে এই পথে অন্তত তিন হাজার ১২৯ মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে বলে জানিয়েছে আইওএম। আর ২০১৭ সাল থেকে হিসাবে নিলে এই অভিবাসন রুটে ২০২৩ সালেই সর্বোচ্চসংখ্যক অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। গেল বছরের জুনে গ্রিস উপকূলে ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে গভীর অংশে ‘আদ্রিয়ানা’ নামের একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবেই মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে ৬০০ জনেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী। আইওএম জানিয়েছে, ২০২৩ সালে আফ্রিকা অঞ্চলের এক হাজার ৮৬৬ জন এবং এশিয়া অঞ্চলে দুই হাজার ১৩৮ জন অভিবাসীর মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। আফ্রিকান অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অধিকাংশ মারা গেছে সাহারা মরুভূমিতে এবং স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রপথে। জাতিসংঘের সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২৩ সালে অভিবাসন রুটে মারা যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অর্ধেকেরও বেশি মারা গেছে পানিতে ডুবে। ৯ শতাংশ মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায় এবং সাত শতাংশ মারা গেছেন সহিংসতার শিকার হয়ে। সংস্থাটির উপ মহাপরিচালক উগোচি ড্যানিয়েলস বলেছেন, ‘প্রতিটি মৃত্যু একেকটি ভয়ানক মানবিক ট্র্যাজেডি, যা আগামী দিনগুলোতেও পরিবার ও সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করবে।’ ২০১৪ সালে অভিবাসীদের মৃত্যু ও নিখোঁজ সম্পর্কিত একটি ওপেন-অ্যাক্সেস ডেটাবেস হিসেবে ‘মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট’ তৈরি করে আইওএম। প্রকল্পটি বিশ্বজুড়ে ৬৩ হাজার ৮৭২টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। তথ্য সংগ্রহের চ্যালেঞ্জের কারণে প্রকৃত ঘটনা আরো অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। বিশেষ করে পানামার ডারিয়েন গ্যাপ বনের মতো দূরবর্তী অবস্থান এবং সমুদ্রপথ, যেখানে নৌকাগুলো কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যায়—সেখানকার প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা বেশ কঠিন। মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট অনুসারে, ২০১৪ সাল থেকে অভিবাসনের সময় প্রাণ হারিয়েছে এমন ২৬ হাজার ৫৩৩ জনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়নি। ড্যানিয়েলস বলেন, ‘মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট থেকে পাওয়া এই ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যানগুলো আমাদের দেখিয়েছে, বৃহত্তর পদক্ষেপের জন্য আমাদের আবারও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে, যাতে সবার জন্য নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত হয়। তাহলে এখন থেকে ১০ বছর পর মানুষ উন্নত জীবনের সন্ধানে আর জীবনের ঝুঁকি নিতে অনিয়মিত অভিবাসনের পথে পা বাড়াবে না।’ অভিবাসন রুটে প্রাণহানি ঠেকাতে এবং সব ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে দেশগুলোর প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে আইওএম।