মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ অপরাহ্ন

নতুন করে খেলাপির ঝুঁকিতে ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৬ প্রদর্শন করেছেন

ঢাকা: শিল্পোৎপাদন কমে গেছে। ব্যাহত হয়েছে রপ্তানি আয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানামুখী চাপে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে স্থবিরতা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের নীতিমালা পরিবর্তনের ফলে ঋণ পরিশোধের সময় কমে এসেছে। এই অবস্থা নতুন করে ঋণখেলাপি হওয়াসহ নানামুখী চাপের মুখে ব্যবসায়ী সমাজ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাটে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। লুটপাটের টাকার বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ওই সব টাকা এত দিন খেলাপি করা হয়নি।

এখন সেগুলো খেলাপি হচ্ছে। আগে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আড়াল করে কমিয়ে দেখানো হতো। এখন সব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে আগামী মার্চের মধ্যে সব ধরনের ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা কঠোর করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নিয়ম অনুযায়ী খেলাপির বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর এ হার বেশি।

‘দেশের শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট সমাধানের পথ’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে পোশাক খাতে ৩০-৩৫ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। স্টিল কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২৫-৩০ শতাংশ। সিরামিক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। ডিজেল ব্যবহার ও শ্রমিকদের বাড়তি কাজের জন্য খরচ বেড়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন ক্ষুদ্র শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ডিজেল জেনারেটর চালানো সম্ভব নয়। ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধের পথে।

তিনি বলেন, শিল্পখাতে গ্যাসের চাহিদা ১০০ কোটি ঘনফুটের মতো। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত দুই বছরে শিল্প খাতের জ্বালানির চাহিদা বাড়েনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে শিল্প খাতে বিপর্যয় নেমেছে। গত কয়েক মাসে কয়েক শ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। রপ্তানি আয় কমেছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। তবে সরকার বলছে, তারা শিল্পের জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় বিশেষ জোর দিয়েছে। শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। আগামী এক-দেড় বছরে রাজনীতি কোন দিকে যায়, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা। আবার কারা ক্ষমতায় যেতে পারে, তাও তারা বিবেচনায় রাখছেন। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনতে হবে। ১০০ দিনের মধ্যে বিনিয়োগ পরিবেশে পরিবর্তন হবে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান হবে—এমন আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। আগের সরকারের দোসরদের মধ্যে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন। তাদের অনেকেই পালিয়ে গেছেন কিংবা জেলে গেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান এখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। খেলোয়াড় পরিবর্তন করলেই যে বিনিয়োগ বাড়বে, তা নয়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নির্ভরযোগ্য ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি খাতের দুর্নীতির কারণে মূল্যবৃদ্ধি পায়, যা ভোক্তা বা ব্যবসায়ীর ঘাড়ে পড়ে। এ খাতে দুর্নীতি কমাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া ঋণখেলাপি চিহ্নিত হতে শুরু করায় এভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ছাড়া অবলোপনকৃত ঋণ ৬০ হাজার কোটি, অর্থঋণ আদালতে আটকা দুই লাখ ৭৮ হাজার কোটি। আদালতে রিট করার মাধ্যমে স্টে অর্ডার নেওয়া ৭৬ হাজার কোটি টাকাও আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী খেলাপির খাতায় যুক্ত হবে। তাই আগামী বছর প্রকৃত হিসাবায়ন করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়া মানে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়া। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ী সমাজ। যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে। ’

তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের গলা টিপে হত্যা করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এত দিন ছয়টি কিস্তি দিতে না পারলে একজন গ্রাহক খেলাপিতে পরিণত হতো। গত সেপ্টেম্বর থেকে তিনটি কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে খেলাপি করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। আবার আগামী মার্চ (২০২৫) মাস থেকে একটি কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেই খেলাপি করা হবে। ’

এদিকে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের মানুষিক চাপে রয়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য ন্যূনতম রক্ষিতব্য মূলধন (এমসিআর) ও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) থাকতে হবে তাদের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ হারে।

সেই সঙ্গে মূলধন ও দায়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাসেল-৩ কাঠামোর আলোকে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম ৩ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত (এলআর) সংরক্ষণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়, যা ২০২৩ সাল হতে বার্ষিক দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপূর্বক ২০২৬ সালে ৪ শতাংশে উন্নীত করার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২৪ সালের জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লিভারেজ অনুপাত ন্যূনতম সাড়ে ৩ শতাংশ হারে সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন বলেন, অতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতির কারণে মূলধন ঘাটতিতে পড়ে ব্যাংকগুলো। শুধু এই কারণে ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করতে পারবে না কিছু ব্যাংক। একটি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সম্পদ আমানতকারীদের আস্থা। আস্থা ধরে রাখতে মূলধন পর্যাপ্ততা খুবই জরুরি। ঋণ পুঞ্জীভূত হলে ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়ে।

সৌজন্য: কালের কণ্ঠ

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ