ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে কিছুদিন আগে এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মসনদে কাঁপন ধরেছিল। আরজি করে চিকিৎসক খুনের এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠেছিল তুমুল আন্দোলন; যা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতজুড়ে। আর এই আন্দোলনের শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ব্যবহার করা স্লোগান থেকে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়।
সেই আরজি কর আন্দোলন এখন অতীত। নিস্তরঙ্গ। প্রায় শেষ। কিন্তু বাংলাদেশে এক হিন্দু সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার, সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নিপীড়নের অভিযোগকে ‘অস্ত্র’ বানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো নতুন করে আন্দোলনের রাস্তায় নামার ছক কষছে। আন্দোলনের রাজনৈতিক ফায়দার হিসেব-নিকেশ আঁচ করে শাসক তৃণমূলও অবস্থান নিয়েছে। তবে তা খানিক ‘এলোমেলো’ বলে দলেরই অনেকে মনে করছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিকে যেমন বলেছেন, তিনি বিদেশের (বাংলাদেশ) বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানই মেনে নেবেন। তেমনই আবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলেছেন তিনি। অর্থাৎ রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের সঙ্গে তার হিসাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর অংকও যে নেই তা নয়। তিনি বারবার বলছেন, ‘‘আমরা সকলকেই ভালবাসি।’’
২০১৯ সালের লোকসভা, ২০২১ সালের বিধানসভা কিংবা ছ’মাস আগে হয়ে যাওয়া আরও একটি লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজনীতির মূল অস্ত্রই ছিল ‘মেরুকরণ’। তার সঙ্গে জুড়ে ছিল দুর্নীতি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ পাওয়া সাফল্য পরবর্তী কালে আর ধরে রাখতে পারেনি তারা।
সেই বিজেপি বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কথিত অত্যাচার নিয়ে সরব। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পাশাপাশি তাদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর নেতারাও ধারাবাহিক কর্মসূচি নিচ্ছেন। সমান্তরালভাবে চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারও। আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপি মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ী অবশ্য বলছেন, ‘‘আমরা কোনও লাভ-ক্ষতি দেখে রাস্তায় নেই। বাঙালি হিন্দুদের বিপন্ন অবস্থা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।’’
বিজেপির অনেক নেতা বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আবেগ রয়েছে। কলোনি এলাকার বহু মানুষ এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবেন। ফলে সঙ্ঘবদ্ধ করার প্রশ্নে কর্মসূচি করতে হচ্ছে। এ কথা ঠিক যে, গত কয়েকটি ভোটে বিজেপি যেমন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘হিন্দু-মুসলমান’ বা ‘৭০ শতাংশ-৩০ শতাংশ’র কথা বলেছে, তেমনই তৃণমূলও ‘বাঙালি অস্মিতা’কে জাগিয়ে বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ প্রমাণ করার রাজনৈতিক আখ্যান তুলে ধরেছিল।
রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপির কিছু নেতা বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ‘বিপন্নতা’ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন জারি রাখতে পারলে তৃণমূলের বাংলা ও বাঙালির রাজনীতিকে ‘ধাক্কা’ দেওয়া যাবে। তবে সে জন্য সাংগঠনিক জোর কতটা রয়েছে, তা নিয়েও সংশয়ের কথা গোপন করছেন না পদ্মশিবিরের প্রথম সারির নেতারা। কারণ, আন্দোলন আর ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন যে ঐকিক নিয়মে হয় না, তা বিজেপি নেতাদের অজানা নয়।
আরজি কর আন্দোলনে যে নাগরিক ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল রাজপথে, শহরাঞ্চলে যার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি, সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনে তা কোনও ছাপ ফেলেনি। যদিও অনেকের মতে, বিজেপি যে ‘পাঠ্যক্রম’ মেনে রাজনীতি করে, তাতে আরজি কর আন্দোলন তাদের জন্য ‘উর্বর’ জমি ছিল না। তা মাসখানেকের মধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে। বিজেপিও আস্তে আস্তে রাস্তা ছাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয়ে ‘উপযোগী উপাদান’ রয়েছে বলে মনে করছেন পদ্মশিবিরের নেতৃত্বের বড় অংশ।