ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট কি ভদ্ররা খেলেন?

একটা সময়ে খেলা ছিল নিছক বিনোদনের মাধ্যম। শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যেই খেলাধুলায় আকৃষ্ট হতেন অনেকে। মূলকথা হলো- মনকে চনমনে রাখা এবং অন্যদের বিনোদিত করাই ছিল খেলার প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

খেলোয়াড়রা নিজেরাই একে অন্যের প্রতি, সতীর্থ-প্রতিপক্ষ, এমনকি আম্পায়ার কোচিং স্টাফ, কর্মকর্তা এবং খেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও সেভাবে সম্মান দেখান না।

শুধু তাই নয়, খেলা সরাসরি সম্প্রচার অবস্থায় খেলোয়াড়রা একে অন্যের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়ছেন। প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলছেন। কথার লড়াইতো হরহামেশাই দেখা যায়। এই লড়াই অনেক সময় শারীরিক আঘাতের পর্যায়েও পৌঁছে যায়।

অথচ বলা হয়ে থাকে, ক্রিকেট হলো ভদ্রলোকের খেলা। কিন্তু ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটেও অনেক সময় ভদ্রতার লেশমাত্রও খুঁজে পাওয়া যায় না। যে কারণে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট কি আদৌ ভদ্ররা খেলেন?

উদাহরণ হিসেবে যদি বলি- বর্তমানে ভারত সফরে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল। প্রোটিয়া এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন টেম্বা বাভুমা। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার এই অধিনায়কের নেতৃত্বগুণে গত জুনে ইংল্যান্ডের লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

সেই বাভুমার নেতৃত্বে ভারত সফরেও দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ইডেন গার্ডেন্সে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে ভারতীয়দের চোখে চোখ রেখে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করে দক্ষিণ আফ্রিকা।

হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ভারতকে দুই ইনিংসে ১৮৯ ও ৯৩ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইডেন টেস্টে জয়লাভ করে দক্ষিণ আফ্রিকা।

অথচ এই টেস্টের প্রথম দিনে ইনিংসের ১৩তম ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা কয়েকটি উইকেট হারিয়ে বিপাকে ছিল। তখন স্ট্রাইকে ছিলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক বাভুমা। সেই সময় ভারতীয় তারকা পেসার জসপ্রিত বুমরাহর করা একটি ডেলিভারিতে প্যাডে আঘাত লাগে বাভুমার। এলবিডব্লিউর আবেদনের পরে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন রিভিউ নেবেন কিনা, তখন স্টাম্প মাইকে ধরা পড়ে বুমরাহর মন্তব্য- ‘ও তো খাটো’।

বাভুমার উচ্চতা নিয়ে তার এ ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়।

দিনশেষে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং কোচ অ্যাশওয়েল প্রিন্স বলেন, ‘না, এ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। এটা প্রথমবার শুনলাম। আমার মনে হয় না মাঠে যা ঘটেছে, তা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে।’

যে বাভুমাকে নিয়ে ভারতীয়রা অপমানজনক মন্তব্য করেছিল; সেই বাভুমাদের কাছেই ইডেন টেস্টে হেরে এবং গুয়াহাটি টেস্টেও পরাজয়ের শঙ্কায় পড়ে গেছে ভারত। গুয়াহাটি টেস্টে হেরে গেলে সিরিজও হাতছাড়া করবে ভারত।

প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে অপমান করাই নয়, টুর্নামেন্টের চেয়ারম্যানকেও অপমান আর অপদস্ত করতে বিন্দু পরিমাণ ভাবে না ভারতীয়রা।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আমিরাতের দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত-পাকিস্তান। চির প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা থাকতেই পারে; কিন্তু খেলার মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আসার ভারতীয়দের যে পুরোনো বদভ্যাস রয়েছে তার চূড়ান্ত নজির ঘটল এবারের এশিয়া কাপে।

রোটেশন অনুসারে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) সভাপতি নির্বাচিত হয়ে থাকে। সেই হিসেবে এবার এসিসিরি সভাপতি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) সভাপতি মহসিন নকভি। তিনি আবার দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত।

এশিয়া কাপের সভাপতি হিসেবে চ্যাম্পিয়ন দলকে ট্রফি তুলে দেওয়ার কথা মহসিন নকভির। রীতি অনুসারে তাই হওয়ার কথা ছিল। নকভি ভারতীয় দলকে ট্রফি দেওয়ার জন্য মঞ্চে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়েও ছিলেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটাররা ফাইনালে পাকিস্তানকে পরাজিত করে শিরোপা জিতে মহসিন নকভির হাত থেকে ট্রফি নিতে অস্বীকার করে।

ভারতীয় ক্রিকেটারদের দাবি তারা কোনো পাকিস্তানির হাত থেকে শিরোপা নিবে না। যদি তাই হয়- তাহলে ভারতীয়রা জেনে শুনে কেন পাকিস্তানি সভাপতির অধীনে টুর্নামেন্টে অংশ নিল? পাকিস্তানি সভাপতির অধীনে আপনি যদি টুর্নামেন্টে অংশ নিতেই পারেন, তাহলে তার হাত থেকে আপনার ট্রফি নিতে সমস্যা কোথায়?

এর আগে ২০০৭ সালে ভারত সফরে যায় পাকিস্তান ক্রিকেট দল। কানপুরে গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামে ওয়ানডে ম্যাচ চলাকালীন পাকিস্তানের তারকা অলরাউন্ডার শহিদ আফ্রিদির সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ান ভারতীয় তারকা ওপেনার গৌতম গম্ভীর। ভারত-পাকিস্তানের এই দুই তারকার সেই ঘটনা এখনো ক্রিকেট ভক্তদের স্মৃতিতে তাজা।

২০১৩ সালে আইপিএলের একটি ম্যাচে মাঠের মধ্যেই তর্কে জড়িয়েছিলেন তখনকার কলকাতা নাইট রাইডার্স অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর ও বেঙ্গালুরু অধিনায়ক কোহলি। তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল ওই ঘটনা।

শুধু ভারতীয়রাই ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে অভদ্রতা করেনি; বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টার বয় সাকিব আল হাসানও এই অভদ্রতা দেখিয়েছেন একাধিকবার।

এলবিডব্লিউর আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দেওয়ায় ঘরোয়া ক্রিকেটে সজোরে স্টাম্পে লাথি মেরে ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছেন সাকিব।

২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষের ম্যাচে ছক্কা মারতে গিয়ে লং-অফে ধরা পড়েন সাকিব। আউট নিয়ে ধারাভাষ্যকারের আলোচনার সময় প্যাভিলিয়নে বসা সাকিব টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েন। ক্যামেরা দেখেই অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি করেন। এ ঘটনায় দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তিন ম্যাচ নিষিদ্ধও হতে হয় তাকে।

২০১৫ সালের বিপিএলে সিলেট সুপার স্টার্সের বিপক্ষে কট বিহাইন্ডের আবেদন করেন সাকিব ও অন্যান্য ফিল্ডাররা। আম্পায়ার তানভীর আহমেদ তাতে সাড়া না দিলে সজোরে স্টাম্পে লাথি মেরে ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেন সাকিব।

শুধু তাই নয়, ২০২১ সালের ১১ জুন মিরপুরে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তিনবার মেজাজ হারান সাকিব। প্রথমে মুশফিকুর রহিমের এলবিডব্লুর আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে লাথি মেরে স্টাম্প ভেঙে দেন। এরপর আম্পায়ার গ্রাউন্ডসম্যানদের পিচকাভার আনতে বললে রাগে ফুঁসে উঠে হাত দিয়ে স্টাম্প তুলে ছুড়ে ফেলেদেন সাকিব। সেই ম্যাচে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে আবাহনীর দর্শকরা দুয়ো দিলে মেজাজ হারিয়ে হাত দিয়ে অশোভন ভঙ্গি করেন সাকিব। তার মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের অভদ্রতায় ক্রিকেটের সম্মান বারবার নষ্ট হয়েছে।

কিন্তু খেলার প্রতি যাদের বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা আছে; তারা কখনই এমন ঘটনার পূনরাবৃত্তি চান না। তাদের একটাই চাওয়া ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট ভদ্ররাই খেলুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Advertisement
Advertisement (Demo – Google AdSense will appear here after approval)