গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ,হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ছয়টি ঋতুকে ঘিরে আমাদের বছর। মূলত প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা এই ছয় ঋতুর বৈশিষ্ট্য বিচারেই হয়ে থাকে। আর এই ঋতুবদলের সঙ্গে আবহাওয়ার বৈচিত্র্যতা আসে। যার প্রভাব পরে আমাদের জীবন যাপনে। আর জীবন যাপনের প্রধান অনুষঙ্গই হলো খাবার। সুস্থ ভাবে জীবন যাপন করতে হলে অবশ্যই ঋতুভেদে সঠিক খাবার শরীরের জন্য প্রয়োজন। আমাদের শরীরে ঋতুভেদে বায়ু-পিত্ত-কফ এই তিনটি ফ্যাক্টর এবং মধুর-অম্ল-লবণ-কটু-তিক্ত-কষা এই ছয়টি রস বিভিন্ন ঋতুতে শরীরে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়। আর শরীরকে সুস্থ রাখতে এগুলি সব ঋতুতেই সমান ভাবে সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা প্রয়োজন। পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শাহনীলা তৈয়ব ছয়ঋতুর বদলের সঙ্গে সঠিক খাদ্যগ্রহণের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। চলুন জেনে নেয়া যাক – গ্রীষ্মকালের কঠিন দাবদাহে প্রকৃতি অনেক বেশি রুক্ষ থাকে। এই সময়ে শরীরে কফ দোষের নাশ হয় ও বাতদোষ বৃদ্ধি পায়। তাই এই সময়ে অতিরিক্ত লবণাক্ত, ঝাল স্বাদযুক্ত, টক জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এসময় বেশিমাত্রায় ঠান্ডা পানীয় হজম শক্তির নাশ করে তাই যতটা পারা যায় তা বর্জন করতে হবে। এছাড়া এ ঋতুতে মিষ্টি জাতীয় লঘু বা সহজপাচ্য খাবার-পানীয়, ঈষৎ ঠান্ডা ও তরলজাতীয় খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা জরুরি। তবে ফ্যাট বা চর্বিজাতীয় খাবার অল্প মাত্রায় চলতে পারে। এবং এসময় ছাতুর শরবত, আমপোড়ার শরবত, আমপানা, পুদিনার শরবত, বিভিন্ন ফল যেমন – মুসাম্বি, আম, তরমুজ, বেল ইত্যাদি শরীরের জন্য খুব ভালো। গ্রীষ্মকালে পরিবেশের রুক্ষতাকে দূর করার জন্য প্রচুর পরিমাণে ফল যেমন-আম, জাম, তালশাঁস, লিচু, বেল, তরমুজ, ডাব খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। ভাত, রুটি, মুগডাল, সবুজ শাকসবজি নিত্য খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। আমলকী, পালং বা আমলকীর রস বিশেষভাবে উপকারী। এছাড়া এসময় তুলসী, হলুদ, শিম, সজনে ইত্যাদি ভেষজ খাদ্যতালিকায় রাখলে ভাল। বর্ষাকালে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব হয়।এসময় অবশ্যই খাবার পানি ফুটিয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে পান করতে হবে। পানি ফোটানোর সময় অল্প পরিমাণে ধনে, মৌরী বা তুলসীপাতা দেওয়া যেতে পারে। অতিরিক্ত মাত্রায় তেল, ঘি, চিজ ও অন্যান্য তৈলাক্ত বা চর্বিজাতীয় খাবার এসময় না খাওয়াই উচিত। পুরনো চালে ভাত, মাংসের পাতলা ঝোল, সুপ ইত্যাদি এ সময়টা স্বাস্থ্যকর। প্রকৃতির বৈচিত্র্যতায় হেমন্তের রুপবৈশিষ্ট যেন অপার। এর সঙ্গে এ ঋতুতে ঘটে বিভিন্ন ধরনের ফলের সমারোহ । এ ঋতুর বিশেষ কিছু ফল হলো কামরাঙা, চালতা, আমলকি ও ডালিম। এছাড়া নারিকেল এ ঋতুর প্রধান ফল। সুতরাং পিঠা তৈরির তালিকায় বেশি থাকে নারিকেলের তৈরি পিঠা। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দু’মাস জুড়ে বাংলার প্রকৃতিতে স্বীয় বৈশিষ্ট্যতা নিয়ে আবির্ভূত হয় ফসলের ঋতু হেমন্তকাল। আর এ হেমন্তকাল জুড়েই আমরা দেখতে পাই আমন ধানের খেত, যা খুবই সুন্দর ও নয়নকাড়া, কচিকাঁচা ধানগাছগুলো সতেজ হতে আরম্ভ করে ক্রমেই। আর ধানগুলো যখন পাকে সারাটি মাঠে তখন সোনালী সূর্যের মতো চিকচিক করতে থাকে। ঠিক যেন সূর্য কিরণের মিষ্টতায় অপরূপ সৌন্দর্যের দৃশ্য সৃষ্টি করে। আগেকার দিনে বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক মাসে ধান পরিপক্ব হয়। কৃষকেরা এই সময় খুশিমনে পাকাধান কেটে ঘরে তোলে। নতুন ধানের পিঠা-পুলি আর খেজুরের রসে ডুবা আয়োজনে ব্যস্ত হয় নবান্ন উৎসব পালনে। অন্যদিকে গ্রীষ্ম ও বর্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায় শীতকালে। এসময় তাপমাত্রা থাকে কম, আবহাওয়া থাকে শুষ্ক। শরীরে পানির চাহিদা অন্যান্য সময়ের তুলনায় কমে যায়। দেহে অতিরিক্ত তাপ থাকে না। এজন্য শরীর ঠাণ্ডা রাখে, এমন খাবারের চাহিদা এ সময় কমে যায়। তাই দেহের তাপমাত্রা শীতল রাখে, এমন খাদ্য খাওয়ার প্রয়োজন নেই। শীতকালে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি খাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন ধরনের শাক, সরিষা, বিভিন্ন ধরনের শিম, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মেথি শাক ইত্যাদি। ফলের মধ্যে, আমড়া, জাম্বুরা, কমলা খাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া এসময় শরীরের তাপমাত্রা কম থাকায় ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া যেতে পারে। ক্যালরি বৃদ্ধির জন্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে। এগুলো আমিষ জাতীয় খাদ্য এবং পরিপাক হতে একটু বেশি সময় নেয়। তাই শীতকালে এ ধরনের খাবার গ্রহণ করা বেশি দরকার। অনেকেই হাঁসের মাংস খুব পছন্দ করেন। হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্য এটি উপযুক্ত সময়। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’র জন্য তাই ভাতের কথা আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তবে স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভাত বা রুটির তুলনায় শাক-সবজি ও ফল বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। বসন্তের উষ্ণ আবহাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ওঠে আর বাতাসের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে জলবসন্ত আর হামজাতীয় রোগের প্রকোপ দেখা দেয় এই সময়ে। বাতাসে ছড়ানোর কারণে এগুলো বেশ ছোঁয়াচে এবং খুব তাড়াতাড়ি একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। এসব কারণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার এবং ব্যথানাশক খাবার আমাদের গ্রহণ করতে হবে। যেমন গরম চা, গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসি পাতার রস ইত্যাদি মিশিয়ে পান করা। এছাড়াও ভিটামিন ই, ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন, কাঠবাদাম, গ্রিন টি, আনারস, আঙুর, ভুট্টা, লাল আটা, বাদাম তেল, জলপাই, উদ্ভিজ্জ তেল, ব্রকলি খেজুর ইত্যাদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। কারণ এসব খাবার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মূলত, যে ঋতুতে যে সমস্ত শাকসবজি, ফল-মূল পাওয়া যায় তাই দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া মদ্যপান, ধূমপান বা অন্যান্য তামাকজাতীয় নেশা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।