মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৪ পূর্বাহ্ন

আইএমএফ ঋণ: বাংলাদেশের জন্য ধারালো দ্বিমুখী তলোয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৬ প্রদর্শন করেছেন

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে এ ঋণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কী হবে, তা নিয়ে। ঋণটি আয়ব্যয়ের ভারসাম্য চ্যালেঞ্জ ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা মোকাবিলার জন্য একটি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, বাস্তবতা হলো, প্রায়শ এ ধরনের ঋণ কিছু কঠিন শর্তের সঙ্গে আসে, যা দুর্বল জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির প্রবণতা সত্ত্বেও আইএমএফ আরোপিত কঠোর শর্তাবলি মোকাবিলা করতে গিয়ে সংকটময় অবস্থায় পড়তে পারে।

নাগরিকদের ক্ষতির বিনিময়ে সাশ্রয়ীনীতি : আইএমএফের ঋণ সাধারণত কঠোর শর্ত ছাড়া খুব কমই বিতরণ হয়, বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণটিও এর ব্যতিক্রম নয়। ঋণটির ফলে সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের পদক্ষেপ নিতে হবে; যার অন্তর্ভুক্ত আছে জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং খাদ্যের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি ট্যাক্স বাড়ানোও। এ পদক্ষেপগুলো আর্থিক ভারসাম্য স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে হলেও, তা অবশ্যম্ভাবীভাবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। যে দেশটি ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার অর্থনৈতিক প্রভাবের মুখোমুখি, এমন নীতিগুলো দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং বৈষম্য আরও গভীর করতে পারে।

অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব সংকটাপন্ন : আইএমএফ ঋণের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের ক্ষয়। বাংলাদেশ সরকার এখন ওয়াশিংটনে তৈরি নীতিমালার অনুসরণ করতে বাধ্য থাকবে, যা প্রায়ই দেশের বিশেষ আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়েই আরোপিত। এ নীতিমালাগুলো সামাজিক কল্যাণের চেয়ে আর্থিক শৃঙ্খলাকে অগ্রাধিকার দেয়, যা সরকারের স্থানীয় প্রয়োজনের সঙ্গে উপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য যা স্বদেশি উদ্যোগের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, এ বাহ্যিক হস্তক্ষেপ উদ্ভাবন এবং স্বনির্ভরতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

ঋণফাঁদের সতর্কতা : আইএমএফ ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসে, যা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে একটি গুরুতর অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এমনিতেই বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ দিনকে দিন বাড়ছে, তার মধ্যে নতুন এ ঋণ সে বোঝা আরও বৃদ্ধি করবে। যদি অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি এবং রাজস্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশ ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে, যা আরও ঋণ গ্রহণে বাধ্য করবে এবং নির্ভরশীলতার এক চক্র তৈরি হবে। এ ঘটনার নজির ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দেশে পরিলক্ষিত হয়েছে, যেখানে আইএমএফের কর্মসূচিগুলো গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করেছে।

সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : আইএমএফ আরোপিত কঠোর সাশ্রয় নীতির আর্থসামাজিক প্রভাব সাধারণত ব্যাপক জন অসন্তোষের আকারে ফুটে ওঠে। যেহেতু জনসেবামূলক কর্মকা গুলো কমিয়ে আনা হয় এবং দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, সেহেতু প্রতিবাদ ও অস্থিরতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। একটি শক্তিশালী সুশীল সমাজের দেশ বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এসব অন্যায় ও বিদেশি নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ দেখা যেতে পারে যার দরুন উদ্ভূত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতার ওপর ত্রুটিপূর্ণ গুরুত্বারোপ : অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আইএমএফের পন্থাগুলো প্রায়ই তাৎক্ষণিক রাজস্ব ও আর্থিক লক্ষ্যমাত্রার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, যেমন বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু এ স্বল্পমেয়াদি পন্থাগুলো দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাপকভাবে ব্যাহত করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো পর্যাপ্ত তহবিল না পেলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আইএমএফের ঋণগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক পতন এড়াতে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপিত হলেও এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিও জড়িত থাকে। বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যেন দেশটি পুরোপুরি বাহিক অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। সরকারকে তহবিল ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য বিকল্প পথও অনুসন্ধান করতে হবে যেমন রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, শাসনব্যবস্থা উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ শক্তিশালীকরণ। আইএমএফ ঋণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জন্য সাময়িক স্বস্তি দিতে পারবে ঠিকই, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তিই বেশি তৈরি করবে। দেশ তার অর্থনৈতিক নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে, নাগরিকদের ওপর কৃচ্ছ্রসাধন নীতির বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে, এবং একটি নির্ভরশীলতার চক্রে আটকে যেতে পারে; যা এতদিনের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অগ্রগতি ধ্বংস করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশকে এ চুক্তি আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের সন্তুষ্টির চেয়ে নিজের নাগরিকের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নইলে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে আইএমএফ ঋণ।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ