রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। জোটের শরিক দলগুলো রাজনৈতিকভাবে নিষ্প্রভ, নেতা-কর্মীরাও এক প্রকার সংশয়-দোলাচলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। কেননা তারা কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে পারছেন না। পারবেন কি না, সেটাও তারা জানেন না। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগের সরকারের। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। বিদেশে পালান আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক নেতা ও পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। অনেকে গা ঢাকা দেন।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরাও আড়ালে চলে যান। প্রায় চার মাস পার হওয়ার পরও এই দলগুলোর নেতা-কর্মীদের আতঙ্ক কাটছে না। দলগুলো স্থবির, নিস্ক্রীয় ও অস্থিত্বহীন হয়ে আছে। ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলে রয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ছাড়া বাকি সবারই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন রয়েছে।
রাজনৈতিক ‘সত্তা’ আলাদা হলেও ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশনের মতো দলের শীর্ষ নেতারা অনেকটাই শেখ হাসিনার হুকুম তামিল করতেন। এমনকি জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছিল ১৪ দল। আগস্টের প্রথম থেকে তারা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামারও পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু সরকার আর তার দল ও শরিকদের সব পরিকল্পনা উড়িয়ে দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটে যায় ৫ আগস্ট।
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ১৪ দলের শরিক দলের নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হয়েছেন সরকার পতনের প্রথম দিকেই। ‘সুসময়ে’ দলের শক্তি ও সামর্থ্য অনুসারে নানা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে অবস্থান জানান দিলেও গত ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত দলগুলোর কোনো নেতাকর্মী সক্রিয় কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেননি। প্রকাশ্যে মাঠে নামতে তো পারছেই না, ঘরোয়াভাবেও কোনো সভা করার সুযোগও পাচ্ছে না দলগুলো। কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত সব জায়গায় একই অবস্থা বিরাজ করছে।
১৪ দলের বেশ কিছু নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নীতি-নির্ধারণী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে। কেননা, হত্যা, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন মামলায় গত দেড় মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার বেড়েছে। এজন্য পতিত সরকারের শরিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। দলের কার্যালয়গুলোয় প্রতিনিয়ত নজরদারি চলছে। বিশেষ করে জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের নেতা-কর্মীদের ওপর চাপ বেশি। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় দলগুলোর নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন মামলায় কর্মীদের নামও রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় আসামি নেতা-কর্মীদের বাড়িতে পুলিশ যাচ্ছে। যাদের নামে মামলা নেই তারাও অনেকে বাড়িতে থাকছেন না। যেসব মামলায় অজ্ঞাত আসামি রয়েছে সেসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারেন, এমন ধারণা করেও ১৪ দলের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এই সংকটের মধ্যে ১৪ দলীয় জোট টিকবে কি না, তা নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন জোটের শরিকদের অনেক নেতা-কর্মী। সরাসরি কেউ কিছু না বললেও তারা মনে করেন, ছাত্র আন্দোলনে দেড় সহস্রাধিক হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই জোট বজায় থাকলে তাদের নীতি অনুসরণ করেই চলতে হতে পারে। একই সঙ্গে তাদের মতো আইনি পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নাম না প্রকাশের শর্তে জাসদের এক কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেপ্তার বেড়ে যাওয়া, বাড়ি বাড়ি পুলিশ যাওয়া, থানা থেকে কল করে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। দলের যারা নামে পরিচিত বা এলাকার মানুষ যাদের নামে চেনে তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এতে নেতা-কর্মীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। নানা চাপের মধ্যে হুমকিও বিদ্যমান। গত দেড় মাসে এ ধরনের সমস্যা আরও বেড়েছে। যাদের নামে মামলা নেই তারাও গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন। কত দিন এভাবে চলবে কোনো ধারণাই করা যাচ্ছে না।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর এক সদস্য বলেন, দল থেকে কোনো কর্মসূচি নেওয়া যাচ্ছে না। আমরাও প্রকাশ্য কোনো তৎপরতায় যেতে পারছি না। প্রচণ্ড চাপে রয়েছেন আমাদের সব পর্যায়ের নেতারা। কর্মীরাও ভীত। ১৪ দলের শরিক হয়ে সবাই কমবেশি সংকটে দিন পার করছে। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ বেশি সংকটে রয়েছে। ১৪ দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে মাঝে মধ্যে ফোনে কথা বলি। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে আমাদের।