ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত আগস্টে সরকারের পটপরিবর্তন ঘটে। পরে অন্যান্য খাতের মতো ব্যবসায়ও কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়, যদিও আগের সরকারের সময় থেকেই ব্যবসায়ীরা এমন অস্থিরতার অভিযোগ করে আসছিলেন।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ডিসেম্বরে এসেও নির্বিঘ্নে উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারছে না বলে জানাচ্ছে।
তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নতুন বিনিয়োগে আস্থার সংকটে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় কেনাকাটায়ও ভাটা পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তার মেঘ দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে দেশে ও বিদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় সমস্যা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
তারা মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন হলে তা করতে হবে। সরকার যদি দৃশ্যমান পরিবর্তন কিছু দেখতে পারে, তাহলে তা দেশ ও ব্যবসায়ীদের আস্থার জায়গায় ফেরাবে এবং বাণিজ্যের জন্য ভালো হবে।
এদিকে বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে চাল, আলু, পেঁয়াজ, চিনি, খেজুর, ভোজ্য তেলসহ বেশকিছু পণ্যে শুল্ক-কর ছাড় দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়ার পরও বাজারে সরবরাহ চ্যানেলে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
পণ্যের পরিমাণ কম থাকায় দাম আকাশচুম্বী। বাজারে উধাও হয়ে গেছে বোতলজাত ভোজ্যতেল। অন্য সব পণ্যের ক্ষেত্রে সুবিধা বহাল থাকলেও আমদানির পরিমাণ কম। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় সব পণ্যের দাম ক্রেতাদের সাধ্যের বাইরে। এতে অস্থিরতায় পড়েছেন ক্রেতারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা খুবই কঠিন সময় পার করছেন। ডলার সংকটের জেরে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছেন না অনেক ব্যবসায়ী। তবে ভয় ও নানামুখী চাপে প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারছেন না।
গত জুলাই মাস থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দা চলছে। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির মতো ব্যবসায় ধস নেমেছে। ব্যাংকের সুদ, বাড়িভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিতে বেগ পাচ্ছে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কবে ঠিক হবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ ডন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ৫ আগস্টের পর ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা। হঠাৎ করে এত বড় পরিবর্তন, সেখানে গাড়ি বলুন, ফ্ল্যাট বলুন, জমি বলুন, নিত্যপণ্য ছাড়া সবকিছুতে একটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। মানুষ ভাবছে কী হয়! পরিস্থিতি কোথায় যায়! আমি যদি শুধু গাড়ির কথা বলি, তাহলে প্রায় ৭০ ভাগ বিক্রি কমে গেছে।
ব্যবসায়ীদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। পাঁচ মাস ধরে ব্যবসা নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এই সময়ে আমাদের বহুমুখী সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছি না। আবার সুদহারও বেড়ে গেছে। এর ফলে যা হয়েছে, একদিকে ব্যবসা করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে সুদের হার বেড়েছে।
বারভিডা সভাপতি বলেন, এ সময় ব্যাংকগুলো অনাদায়ী ঋণের জন্য চাপ দিয়ে খাঁড়ার ঘা তৈরি করেছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আরও সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে। ফলে আমাদের মতো আমদানিনির্ভর ব্যবসায়ীরা খুব সমস্যার মধ্যে রয়েছেন।
তিনি বলেন, এ অবস্থা কতদিন চলতে থাকবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আইনশৃঙ্খলা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওই সময়ে আইনশৃঙ্খলার বেশ অবনতি ঘটে। সঙ্গত কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক ছিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
ব্যবসায়ী এই নেতা বলেন, এত বড় একটা পরিবর্তনের পর আশা করি ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা মনে করছি ছয় থেকে আট মাস এমন অবস্থা থাকবে। আশা করছি, আগামী বছর ঠিক হয়ে আসবে। ২০২৫ সাল থেকে ব্যবসা ভালো হবে।
এদিকে সরকারে পরিবর্তনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক শিল্পকেও বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই শিল্পে অনিশ্চয়তা এখনো পুরোপুরি কাটেনি বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বাংলানিউজকে বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের চলমান অস্থিরতা দূর হয়েছে কি না বা নিষ্পত্তি হয়েছে কি না তা তখনই বলা যাবে, যখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে।
তিনি বলেন, আমরা দেখছি শিল্প পুলিশ এখনো আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারেনি। সরকারের উচ্চ মহল থেকে দিকনির্দেশনা যেভাবে থাকার কথা রয়েছে, এখনো তাতে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। এ কারণে আসলে ছোট ইস্যুগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অল্পতেই রাস্তায় নেমে যাওয়া, ভাঙচুর করার মতো প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যারা এটি করছে, বলা হচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না। তাদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না । যে আমার কারখানা পোড়াতে আসবে, যে আমার গ্লাস ভেঙে ফেলবে, আর তাকে আমি কিছু বলতে পারবো না, তা হতে পারে না।
এ বিষয়ে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাসেম খান বাংলানিউজকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হয়েছে ২০২১ সাল থেকেই। গত সরকার কিছু খারাপ পলিসি ও বিশ্ব অর্থনীতির একটি প্রভাব অর্থনীতিতে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড, ব্যাংকের সুদের হার, তথ্যের গড়মিল এসবের জন্য অর্থনীতি চাপের মুখে আছে।
তিনি বলেন, আমরা যেহেতু একটি পরিবর্তিত সরকারে আছি, সেখানে সব কিছু নতুন হবে, নতুন দিকনির্দেশনা, নতুন ধারণা থাকবে। তাই আমরা আশাবাদী যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। আমাদের সেই আশাটা রাখতে হয়। কারণ আমরা যারা দেশে ব্যবসা করি, বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারি না, আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা মেনেই বিনিয়োগ করতে হয়। বর্তমানে আমরা অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে সমস্যা রয়েছে, ঋণ প্রবাহ কমে গেছে, বিদ্যুৎ, গ্যাস সমস্যা লেগেই আছে। এর বাইরে যে বিষয়টি চাপ সৃষ্টি করছে, তা হলো, আইনশৃঙ্খলার ঘাটতি। এগুলো যদি বর্তমান সরকারকে শক্ত হাতে দেখতে হবে। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের আলোচনায় বসতে হবে বা যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে উল্লেখ করে আবুল কাসেম খান বলেন, দেশে- বিদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় সমস্যা আছে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যেমন— আমাদের আমদানি-রপ্তানিতে যে ডেমারেজ দিতে হয়, অযাচিত ট্যাক্স বসানো হয়, এমন অনেক সমস্যা রয়েছে, যেগুলোর সংস্কার প্রয়োজন।
তিনি বলেন, এসব ইচ্ছা করলেই সমাধান করা যায়। সেখানে সরকারকে নজর দিতে হবে। এসব খাতে যদি আমরা ভিজিবল পরিবর্তন দেখতে পারি, তাহলে তা ব্যবসা ও দেশের জন্য ভালো হয়। এজন্য সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মো. সামসুল আলম বলেন, বর্তমানে ব্যবসার পরিস্থিতি করুণ। আমার ব্যবসায়িক জীবনে এতো খারাপ পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। সরকার পরিবর্তনের জন্য খারাপ হয়েছে তা নয়, তার অনেক আগের থেকেই খারাপ। দেশের অর্থনীতি করোনার পর আর ভালো হয়নি, আমাদের অবস্থাও একই রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ইসলামপুরের শতকরা ৮০ শতাংশ দোকানে সারা দিন কোনো কিছু বিক্রি হয় না। আর যে ২০ শতাংশ দোকানে বেচাকেনা হয় তাও ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি হয় না। আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা আর সর্বোচ্চ লাখ টাকা বিক্রি হতো। এভাবে চললে আমরা শেষ হয়ে যাব। তিনি বলেন, আমরা যে ব্যবসাটা টিকিয়ে রাখব সেজন্য টাকার প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংকগুলো টাকা দিতে পারছে না। আমরা যে টাকা রেখেছি সেটাই তারা দিচ্ছে না। ঋণ তো দূরের কথা। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে টাকা নেই। দ্রব্যমূল্য এতো বেশি যে, মানুষ নিত্যপণ্য কিনবে নাকি কাপড় কিনবে। আমরা এলসি খুলতে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছি না। বরং একাধিকবার এলসি বাতিল করা হয়েছে। যার কারণে বাজারে আমাদের কাঁচামাল সরবরাহ কমে গেছে।
এ ছাড়া ডলারের রেট বেশি, আমদানি কমেছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেশি ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু বিক্রি নেই বলে জানান তিনি। ব্যবসায়ী এই নেতা বলেন, তাহলে আমরা ব্যবসাটা করব কীভাবে? এ অবস্থা করোনাকাল থেকেই শুরু হয়েছে। এখন নতুন সরকার যদি আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থের যোগান করে দিতে পারে, এলসি করার ব্যবস্থা করে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সহনীয় করে, তাহলে আমরা ব্যবসাটা পুরোদমে চালিয়ে যেতে পারব।