আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী শীর্ষ ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদের রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থপাচার অনুসন্ধানে যৌথ টিম গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে অর্থপাচারের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
যার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থপাচার ও রাজস্ব ফাঁকি অনুসন্ধানে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরামর্শে ওই যৌথ অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। যেখানে দুর্নীতি দমন কমিশনের মনোনীত একজন কর্মকর্তা ওই অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ নেতৃত্ব দেবেন। আর সমন্বয় করবে বিএফআইইউ। অনুসন্ধান টিমের অন্য সদস্যরা হলো—কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এই যৌথ দল এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট ও আরামিট গ্রুপ ছাড়াও বেশ কয়েকটি শীর্ষ গ্রুপের বা ব্যক্তির অর্থপাচার অনুসন্ধান ও তদন্ত করবে। এছাড়া সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অর্থপাচারের বিষয়টি যৌথ টিমের আওতায় অনুসন্ধান চলছে। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৪ ডিসেম্বর বিএফআইইউ থেকে অনুসন্ধানকারী সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে সম্প্রতি বিএফআইইউ পর্যালোচনায় সংশ্লিষ্ট এসব গ্রুপ ও ব্যক্তির দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকিং নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়ে বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার নজির মিলেছে। এসব ব্যবসায়িক গ্রুপের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক ফাঁকি, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব গ্রুপ ও সেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি ব্যাংক ঋণের অর্থ আত্মসাৎ, বিভিন্ন বৈধ বা অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থ মানিলন্ডারিং বা বিদেশে পাচার করা হয়েছে কি না সে বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান ও তদন্ত করা আবশ্যক। এজন্যই যৌথ টিম গঠন করা হয়েছে।
তারা আরও বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও এনবিআরের আওতাধীন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে নিয়ে এই যৌথ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। দুদক মনোনীত কর্মকর্তা এই অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে নেতৃত্ব দেবেন এবং মামলার চার্জশিট দাখিলের ক্ষেত্রে নিজ সংস্থার অনুমোদন গ্রহণ করে আদালতে দাখিল করবেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সূত্রে আরও জানা যায়, অনুসন্ধানকারী দল আইন ও বিধি মেনে প্রতিটি গ্রুপের ১০টি কাজ করবে। যার মধ্যে রয়েছে—মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন বিষয়ে আইন এবং বিধি অনুসরণ করে অনুসন্ধান ও তদন্ত; এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা আইনি সহায়তা ও পরামর্শ দেবেন; অনুসন্ধানের তথ্যের গোপনীয়তা ও সংবেদনশীলতা কঠোরভাবে রক্ষা করা; বিদেশে পাচার করার সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স ও বিএফআইইউকে তথ্য সরবরাহ করা; চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজ সংস্থার অনুমোদন নেওয়া; সব তথ্য ও দলিলাদি বিএফআইইউতে সংরক্ষণ; অনুসন্ধান দলের কর্মকর্তাদের ভাতা সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করবে; অনুসন্ধান দলের কার্যক্রম হবে বিএফআইইউতে এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে; অনুসন্ধান দলের প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস ও ফান্ড বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে এবং বিএফআইইউ অনুসন্ধান দলের মধ্যে সমন্বয় ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।
অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ছাড়াও শেখ হাসিনা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশে-বিদেশে সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে এনবিআর। যেখানে নাম রয়েছে—শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, তার বোন শেখ রেহানা, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে ফাহিম, শেখ হেলাল, শেখ তন্ময়, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং তাদের পরিবারের সদস্য ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম।
এস আলম গ্রুপের মালিক এস আলম ও তার সহযোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপরাধ, প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। এস আলমসহ তার সহযোগী ব্যক্তিরা ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর বেক্সিমকো গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠান ১২ বছরে প্রায় ৯৫৭ কোটি টাকা পাচার করেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ তিনটি দেশে এই অর্থপাচার করা হয়েছে।