সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:১৬ অপরাহ্ন

‘রাঙ্গা ভাবী’ সিনেমার সেই বাবলার কথা কি মনে আছে?

প্রতিবেদকের নামঃ
  • প্রকাশের সময়ঃ বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ২৩ প্রদর্শন করেছেন

সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা শেষ। পড়ে দেখলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবানা। সবই পছন্দ হলো। তাঁর দাবি ছিল, সিনেমায় মাস্টার টাপু নামে এক শিশুশিল্পীকে নিতে হবে। আপত্তি করলেন না পরিচালক মতিন রহমান। ডাকা হোক টাপুকে।
শাবানা জানালেন, এই শিশুর বাড়ি কলকাতায়। তার সঙ্গে কদিন আগে বলিউডের একটি সিনেমা শুটিং করে এসেছেন। এটাও জানালেন, শুধু তিনিই নন, রাজেশ খান্নাদের মতো অভিনেতার সঙ্গে টক্কর দিয়ে অভিনয় করেছে সে। তবু বাদ সাধলেন পরিচালক। তিনি শাবানাকে জানালেন, দেশে মেধাবী শিশুশিল্পীর অভাব নেই, তাদের কাউকে নিলেই হয়। পরে অবশ্য শাবানাকে আর না করতে পারলেন না।
মতিন রহমান তখন ‘রাঙ্গা ভাবী’ সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে ডাকা হলো এই শিশুশিল্পী মাস্টার টাপুকে। মা-বাবাসহ হোটেলে দেখা করতে এল সে। প্রথম দেখাতেই অনেকটা পছন্দ হলো পরিচালকের। কথা বলে বুঝতে পারলেন, ছেলেটি খুবই চটপটে, চনমনে। তাকে সিনেমার কিছু লাইন ধরিয়ে দিলেন। সেটা নিজের মতো করে বলে দেখায়।
মতিন রহমান বলেন, ‘তাকে একবার বলে দিলেই সব নিজের মতো সুন্দর ও ন্যাচারালভাবে অভিনয় করে দেখাত। তার মধ্যে কোনো ভয় বা জড়তা ছিল না। তার অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। শিশুটি আলমগীর, শাবানাসহ সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেমন অভিনয় করবে, সেটা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম।’
সেই সময়ে কলকাতায় জনপ্রিয় হয় ‘শত্রু’ সিনেমা। রঞ্জিত মল্লিক ছিলেন সিনেমার অভিনেতা। তিনি পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমাটিতে এক শিশুর বাবাকে এই পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সে শিশুটি পুলিশের বাড়িতে আসে তার বাবাকে ছাড়িয়ে নিতে। প্রতিবাদী চরিত্রে অভিনয় করে টাপু প্রশংসা পায়। কলকাতায় তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
মতিন রহমান বলেন, ‘সেই সময়ই আমি চিত্রনাট্য নিয়ে “শত্রু”সিনেমার পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। তখন অঞ্জনও আমাকে শিশুটির কথা বলে। আমার “শত্রু” দেখা ছিল। তখন আরও ভালো রিলেট করতে পারলাম। মিষ্টি একটা ছেলে। অনেক বড় দৃশ্যও সে মনে রাখতে পেরেছিল। ঠিকমতো অভিনয় করেছিল। আবার ইম্প্রোভাইজও করেছিল। আলাদা টেনশন হয়নি।’
‘রাঙ্গা ভাবী’ সিনেমায় তিনটি প্রধান চরিত্রের একটিতে অভিনয় করে এই শিশু। সিনেমায় অভিনয় করার সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর। তার চরিত্রের নাম ছিল বাবলা। গল্পে দেখা যায়, মা মারা যাওয়ার পর বাবলা গ্রাম থেকে শহরে আসে সৎভাইয়ের কাছে। তার সৎভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন আলমগীর। কিন্তু আলমগীর তার সৎভাইকে বাসায় নিয়ে আসতে চায় না। ঘটনাক্রমে সে ভাইয়ের বাসায় আসে। ভাই আর ভাবি চরিত্রের শাবানাকে নিয়ে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে ‘রাঙ্গা ভাবী’র গল্প।
এই টাপুর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি দৃশ্য ছিল শাবানার। একসঙ্গে শুটিং করতে গিয়ে আরও ভালো সম্পর্ক হয়। তার অভিনয়ে বারবার মুগ্ধ হন শাবানা। শাবানার সঙ্গে প্রথম শিশুটির পরিচয় কীভাবে, জানতে চাইলে পরিচালক মতিন রহমান জানান, ‘শত্রু’ সিনেমাটি কলকাতার পর বোম্বেতেও রিমেক হয়। তখন এই টাপুর বিকল্প কাউকে পাচ্ছিলেন না পরিচালক। কলকাতা থেকে আবার এই শিশুকেই নিয়ে যাওয়া হয়।
‘“শত্রু” রিমেক হলে সেখানে রাজেশ খান্নার সঙ্গে অভিনয় করেন শাবানা। সেই গল্পে টাপুর অভিনয় এতটাই মনে দাগ কাটে যে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শিশুটির কথা তাঁর মাথায় ছিল। ভাবছিলেন, দেশে কোনো ভালো গল্প হলে ছেলেটিকে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব দেবেন। সুযোগটা কাজে লেগে যায়, “রাঙ্গা ভাবী” সিনেমার গল্পে। শিশুটি অল্প সময়েই আলমগীর, শাবানাসহ আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।’ বলেন মতিন রহমান।
ঝুঁকি থাকলেও কোনো দৃশ্যতেই না করত না শিশুটি। শুটিংয়ের প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। একটি দৃশ্যের শুটিং করা হয়েছিল, মায়ের বালা চুরি করে রেলিং টপকে, পিলার থেকে লাফ দিয়ে পালাবে। নির্মাতা বলেন, ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্য। অনেক ওপর থেকে লাফ দিতে হবে। দেয়াল টপকাতে হবে। যেকোনো সময় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে জেনেও রাজি হয়ে গেল। সেভাবেই ভয়ে শুটিং করলাম। কিন্তু শিশুটির মধ্যে ভয়ের চিহ্ন দেখিনি।’
বাংলাদেশ ও নেপালে সিনেমাটির শুটিং হয়। দিন যত যায়, ততই সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এবার যাওয়ার পালা। মায়ের সঙ্গে কলকাতায় যায়। ঢাকা থেকে পছন্দের সব সঙ্গে নিয়ে যায়। তারপরই আড়ালে চলে যায় শিশুটি।
এর মধ্যে সিনেমাটি দেশে ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়। টানা দেড় থেকে তিন মাস বিভিন্ন সিনেমা হলে চলে। দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে এই বাবলা। আলোচনায় থাকেন আলমগীর ও শাবানা। সে বছর শাবানা সিনেমাটিতে অভিনয় করার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
সে সময় সিনেমাটির সাফল্য ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয় বলে জানান পরিচালক। সেখানেও পরিচালক কাজী জহিরসহ সবাই টাপুর প্রশংসা করেন। সিনেমা দেখেও বহু নারী দর্শক এই শিশু চরিত্রের অভিনেতার খোঁজ করেন। তাকে একনজর দেখতে চান।
কিন্তু এই সফলতার গল্প কতটা জানে সেই টাপু, সেটা পরিচালক বলতে পারলেন না। কারণ, সিনেমা মুক্তির পর এই শিশুশিল্পীর সঙ্গে আর কখনোই দেখা হয়নি। শুরুর দিকে কলকাতায় গিয়ে খোঁজ করলেও পরে আর কোনো খবর জানেন না এই পরিচালক। শিশু চরিত্রে সাড়াজাগানো এই শিশুকে পরবর্তী সময়ে আর কলকাতার সিনেমায়ও খুব বেশি দেখা যায়নি।
মতিন রহমান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। কারণ, সে সময় “ডুমুরের ফুল”সহ অনেক সিনেমায় শাকিল নামে একটি শিশু অভিনয় করে। এমন আরও অনেক শিশু ছিল আশি ও নব্বইয়ের দশকের দিকে। কিন্তু এই মেধাবী শিশুরা পরে আর সিনেমায় টিকে থাকতে পারেনি। কী বলব, মেধাবীগুলো অকালেই সিনেমা থেকে হারিয়ে গেল। কেউ আড়াল হলে সে একেবারে আড়ালে চলে যায়। এখানে যে সামনে থাকে, তাকে নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। আমার ইচ্ছা আছে টাপুর খোঁজ করার।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ