বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৭ অপরাহ্ন

রাষ্ট্রপতির ‘সম্ভাব্য বিদায়’ নিয়ে কী ঘটছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময়ঃ বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১৪ প্রদর্শন করেছেন

শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র ইস্যুতে বিতর্ক ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে- এ নিয়েই এখন তীব্র কৌতূহল বিরাজ করছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে ইতোমধ্যেই শক্ত অবস্থান নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ইনকিলাব মঞ্চ, রক্তিম জুলাই, ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র-জনতার মঞ্চসহ তাদের সমমনা বেশ কয়েকটি সংগঠন বঙ্গভবনের রাস্তা অবরোধ করে মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ‘মিথ্যাচার’ এবং ‘শপথ ভঙ্গের’ মত অভিযোগ আনার পর এসব সংগঠনগুলো রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য ‘দৃশ্যত সতর্ক’ পর্যবেক্ষণ করছে পরিস্থিতির। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে এবং দেশের বর্তমান বাস্তবতায় রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের টিকে থাকাটা ‘কঠিন’ হয়ে পড়েছে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

দৈনিক নয়াদিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর বলনে, বিতর্কটা তারই সৃষ্টি। ফলে একে ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সে প্রেক্ষাপটে এখন তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তিনি কী করবেন। আমার মনে খুব শিগগিরই এর সুরাহা হবে।

আরেকজন বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তার কাছে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থেকে যাওয়াটা কঠিন হবে এবং এর কারণ হলো রাষ্ট্রপতি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন।

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে চলতি বছরের এপ্রিলে শপথ নিয়েছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। তখনকার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর তালিকায় তার নাম ছিল।

কর্মজীবনে জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। চাকরি থেকে অবসরের পর হাইকোর্টে আইন পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তিনি।

বিতর্ক, আলোচনা ও গুঞ্জন

শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে দৈনিক মানবজমিনে খবর প্রকাশের পর সরকারের তীব্র প্রতিক্রিয়াতেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিলো যে প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি এবং তখনই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে এই ইস্যুকে কেন্দ্র ‘রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেয়া বা চলে যেতে বাধ্য করার মতো’ পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।

এর আগে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সরকার ঘনিষ্ঠ একটি অংশ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে আসছিলেন।

যদিও সরকার পক্ষের আরেকটি অংশের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকের কাছে মনে হচ্ছিলো যে সরকারের জরুরি সিদ্ধান্তগুলো এই রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে অনুমোদন করানোটাই ‘স্বস্তিদায়ক’ বলে মনে করছেন তারা।

কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য এখন এসবগুলো পক্ষকেই এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। অনেকের ধারণা রাষ্ট্রপতির বক্তব্য ‘পুরো সরকারের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে’ মনে করে সরকার ও সরকার ঘনিষ্ঠরা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন।

সরকার সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সরকারের দুজন উপদেষ্টা মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এরপর পরই খবর ছড়ায় যে তারা রাষ্ট্রপতির ‘সম্ভাব্য অপসারণ’ এবং ‘ওই পদে কে আসবেন’ তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

যদিও সরকার বা প্রধান বিচারপতি- কারও দপ্তর থেকেই এসব বিষয়ে কোন কিছু সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হয়নি।

বাংলাদেশে এর আগে রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগের পর প্রধান বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে।

এর মধ্যে রাতে প্রধান উপদেষ্টার অসুস্থতার খবর চাউর হলে আলোচনা আরও ডালপালা মেলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টাই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হতে পারেন কিনা এনিয়েও আলোচনা দেখা যায়। যদিও সরকারের কারও বক্তব্য বা বিবৃতিতে তেমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

আবার অনেকের ধারণা বিদেশে থাকা সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান দেশে ফিরে আসার পরই মূলত রাষ্ট্রপতি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর শেষে শুক্রবার তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

এখানে বলে রাখা ভালো যে পাঁচই আগস্ট আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধানকে রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনকারী ছাত্রপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে।

সে কারণেই অনেকের ধারণা যে তার ফিরে আসার আগে রাষ্ট্রপতির অপসারণ কিংবা পদত্যাগ কোন কিছুই সম্ভব নাও হতে পারে।

অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সমমনা কয়েকটি সংগঠন দিয়ে ধারাবাহিক বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের একটি ক্ষেত্র’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে সরকারেরই একটি অংশ।

সম্প্রতি শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছে যে মন্তব্য রাষ্ট্রপতি করেছেন তাতে পুরো উপদেষ্টা পরিষদ চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যার বহি:প্রকাশ ঘটেছে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কথায়।

বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় আলোচনার পর সরকারের আরও শক্ত অবস্থান নেয়ার সম্ভাবনা আছে এবং তেমনটি হলে রাষ্ট্রপতি পদে টিকে থাকা ‘মো. সাহাবুদ্দিনের জন্য অসম্ভব’ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।

সালাউদ্দিন বাবর বলছেন পরিস্থিতিটা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নিজেই তৈরি করেছেন, যার কোন প্রয়োজন ছিল না।

তিনি বলেন, তার কার্যক্রমের দায় ওনাকেই বহন করতে হবে। ফলে ঘটনা পরম্পরায় এর যা পরিণতি, দায়িত্ব বা বিতর্ক- সবকিছুর দায় তাকেই নিতে হবে। আমার মনে হয় সেই চাপটাই তৈরি হয়েছে ওনার ওপর। দেখা যাক উনি কী সিদ্ধান্ত নেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলছেন বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তার কাছে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থেকে যাওয়াটা কঠিন হবে।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকা থাকার জন্য যে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও আইনি কর্তৃত্ব থাকা দরকার বর্তমান রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। সে কারণে তার দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়াটা সহজ হবে না।

মারুফুল ইসলাম মনে করেন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা অপ্রত্যাশিত কিন্তু রাজনৈতিক। “যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে সেই সরকারের পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরোনো সরকার বা সাংবিধানিক কাঠামো কাজ করে না। সে অনুযায়ী সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলো হয়নি বলেই বর্তমান ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

পদত্যাগের দাবিতে যা যা হলো

মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে বিকেল থেকে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থানের পর রাতে ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে আন্দোলনকারীরা।

এ সময় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দিলে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।

বিক্ষোভকারীরা গভীর রাত পর্যন্ত বঙ্গভবন এলাকায় অবস্থান করেছে। এর আগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেছে মিছিল সমাবেশ করেছে।

অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে গণজমায়েত করে রাষ্ট্রপতিকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে পদচ্যুত করাসহ ৫ দফা দাবি জানানো হয়।

কী বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি ও পরে যে ব্যাখ্যা দিলেন

দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী পত্রিকাটির দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে মি. সাহাবুদ্দিন বলেন, তিনি শুনেছেন যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তার কাছে এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।

রাষ্ট্রপতি আরও জানান যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবও পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।

পরে এ নিয়ে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ তোলেন।

মূলত এরপরই সরকারের দিক থেকে রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের তৎপরতা শুরু হয়।

পরে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা দেয় বঙ্গভবনের প্রেস উইং। এতে বলা হয় ‘মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে কোন বিতর্ক সৃষ্টি না করার জন্য,’ রাষ্ট্রপতি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ওই ব্যাখ্যায় বলা হয় “এ বিষয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার উপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে সেগুলোর যাবতীয় উত্তর স্পেশাল রেফারেন্স নং-০১/২০২৪ এ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গত ০৮ আগস্ট, ২০২৪ এর আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে”।

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি গত ৮ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাওয়ার প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ এই মতামত দিয়েছিলেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ