বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৪ অপরাহ্ন

ইতিহাসের নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকদের অদ্ভূত যতসব স্বভাব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • প্রকাশের সময়ঃ বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৮ প্রদর্শন করেছেন

অ্যাডল্ফ হিটলার থেকে শুরু করে জোসেফ স্ট্যালিন বা মাও সেতুং। বিশ্বের তাবড় স্বৈরাচারীর মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে অদ্ভুত কিছু আচরণ। যা তাদের কুখ্যাতিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

ইতিহাসবিদেরা স্বৈরাচারীদের ভীরু ও কাপুরুষ প্রবৃত্তির মানুষ বলেন। কারণ, শক্তিশালী হলে ক্ষমতায় আসার জন্য তারা বলপ্রয়োগ করতেন না। আমজনতার একটা বড় অংশকে প্রাণ দিয়ে যার খেসারত দিতে হয়েছে।

তথ্য বলছে, বিদেশি হামলাকারীদের চেয়ে স্বৈরাচারীদের হাতে নিজের দেশের নাগরিকদের মৃত্যু হয়েছে অনেক বেশি। তাদের সবার মধ্যে দুটি বিষয়ে বেশ মিল রয়েছে। একটি হল অবিশ্বাস আর দ্বিতীয়টি হল নির্ধারিত একটি সময়ের পর পতন।

ইউরোপ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতের রাজদূত থাকা রাজীব ডোগরা স্বৈরাচারীদের জীবন নিয়ে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তাদের বেশ কিছু অদ্ভূত আচরণের উল্লেখ করেছেন প্রাক্তন এই আইএফএস অফিসার।

রাজীব তার লেখা ‘অটোক্র্যাটস— ক্যারিশ্মা, পাওয়ার অ্যান্ড দেয়ার লাইভস’ বইতে রোমানিয়ার শাসক নিকোলাই চশেস্কুর উদাহরণ দিয়েছেন। মৃত্যুর এক দশক পরও যার আতঙ্ক থেকে বেরোতে পারেনি পূর্ব ইউরোপের ওই দেশ।

রাজীবের দাবি, রোমানিয়ার আমজনতার মধ্যে সর্বক্ষণ একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করত। তাদের বেশির ভাগই মনে করতেন, চশেস্কুর লোকজন কড়া নজরদারি চালাচ্ছে। যার জেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও যেতে ভয় পেতেন তারা।

রাজীব সেই বইতে লিখেছেন, রাস্তায় হাঁটার সময়ে অনেকেই হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেন, কেউ তাদের অনুসরণ করছেন কি না। পার্কে বসে কেউ সংবাদপত্র পড়লে, আশপাশের সকলেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। খবরের কাগজ ফুটো করে কেউ নজর রাখছেন কি না, তা খোঁজা হত।

বিষয়টি নিয়ে রোমানিয়ার জনপ্রিয় থিয়েটার অভিনেতা ইয়ন কারামিত্রের সঙ্গে কথা বলেন সাবেক ভারতীয় রাজদূত। কারামিত্র তাকে বলেন, আমরা কী খাব, কোন জিনিসটা কিনব, কার সঙ্গে কথা বলব আর কতটা বলব— সবটাই রাষ্ট্র ঠিক করত।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, স্বৈরাচারীদের নিষ্ঠুর স্বভাবের নেপথ্যে তাদের শৈশবের বড় ভূমিকা রয়েছে। লেভিন রেড্ডি ও অ্যাডাম জেমস তাদের ‘থার্টিন ফ্যাক্টস অ্যাবাউট বেনিটো মুসোলিনি’ বইয়ে এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

রেড্ডি-জেমস লিখেছেন, ছোট থেকেই আর পাঁচটা শিশুর থেকে একেবারে আলাদা ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইটালির ‘ইলে ডুচে’। অনুশাসনে আনতে মা-বাবা তাকে একটি ক্যাথলিক বোর্ড স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু সেখানকার শিক্ষক বা অন্য কর্মীরা যে মুসোলিনিকে বাগে আনতে পেরেছিলেন, এমনটা নয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে এক সহপাঠীর ওপর ছুরি নিয়ে চড়াও হন তিনি। ফলে তৎক্ষণাৎ স্কুল থেকে বিতড়িত হন এক সময়ের ইতালির সর্বময় কর্তা।

২০ বছরে পা দিতে না দিতে মুসোলিনির বিরুদ্ধে এই ধরনের একাধিক হামলার অভিযোগ উঠেছিল। নিজের এক প্রেমিকাকেও ছুরি দিয়ে কোপাতে হাত কাঁপেনি তার। মসনদে বসার পর নিজের ‘ঐশ্বরিক’ ইমেজ তৈরি করতে ব্যাপক মিথ্যা প্রচার শুরু করেছিলেন ইলে ডুচে।

২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘দ্য নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ইতিহাসবিদ সিয়ো প্রোডোর একটা উত্তর সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। যার নাম ছিল, ‘ডিক্টেটরস: দ্য গ্রেট পারফরমার্স’। সেখানে তিনি লিখেছেন, ১৯২৫ সালে তার বক্তৃতা শোনার জন্য স্কুলে স্কুলে বিনামূল্যে ৪০ হাজার রেডিও বিলি করেছিলেন মুসোলিনি।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় আট লক্ষ। ওই সময়ে মুসোলিনির ভাষণ শোনার জন্য রাস্তার চৌমাথায় বড় বড় লাউডস্পিকার লাগানো হয়েছিল। সাবানের ওপর ছিল তার ছবি। যাতে স্নানের সময়েও দেশের সর্বাধিনায়কের ছবি আমজনতার চোখে ভেসে ওঠে।

এছাড়া নিজের দপ্তরে আলো সারা রাত জ্বালিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুসোলিনি। তিনি যে সর্বক্ষণ দেশের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন, তা বোঝাতে চেয়েছিলেন ইতালির সাবেক এই স্বৈরাচারী শাসক।

সোভিয়েত শাসক (বর্তমান রাশিয়া) স্ট্যালিনও যৌবনে একাধিক দোকানে অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। বলশেভিক পার্টির সাম্যবাদী আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল টাকার। যা জোগাড় করতে রুশ ধনী ব্যবসায়ীদের অপহরণের অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে। তার প্রকৃত নাম ছিল, ইয়োসেব বেসারিয়নিস ডিজে জুগাশভিলি। পরবর্তী কালে যা বদল করে ‘স্ট্যালিন’ করে নেন তিনি। যার অর্থ লোহার তৈরি।

লাখ লাখ ইহুদি হত্যার করেছেন জার্মান ‘ফ্যুয়েরার’ হিটলার। তিনি আবার ছিলেন পুরোপুরি নিরামিশাষী। জীবনের শেষ দিকে শুধুমাত্র সুপ ও পেষাই করা আলু খেতেন তিনি। তবে ফুড টেস্টারেরা পরখ না করলে খাবার মুখে তুলতেন না হিটলার। সর্বক্ষণ বিষ প্রয়োগে খুনের আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াত তাকে।

হিটলারের ফুড টেস্টার মার্গোভ ভয়েলভ পরবর্তী কালে লিখেছিলেন, ফ্যুয়েরারকে তাজা সবজি খেতে দেওয়া হত। ইতালিয়ান পাস্তা পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু, খাবার এলেই মনে হত, আজই আমাদের শেষ দিন। ফলে ফুড টেস্টিংয়ের সময়ে খাবারের স্বাদ বুঝতে পারতাম না। শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যেতাম।

উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং ইল হাঙর আর কুকুরের মাংসের সুপ খেতেন চেটেপুটে। ডেমিক বার বার লিখেছেন, খাবার পরিবেশনের আগে তার প্রমীলা বাহিনী তা চেখে দেখত। প্রতিটা ভাতের কণা সমান ও একই রঙের রয়েছে কি না, তা ভালো করে পরীক্ষা করতেন তারা।

কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল পটের আবার পছন্দ ছিল গোখরো সাপের মাংস। তার রাঁধুনি রাজীব ডোগরাকে বলেছিলেন, আমরা সাপ মেরে তা বাগানে ঝুলিয়ে রাখতাম। পরে মাথা কেটে সরীসৃপগুলোর রক্ত হোয়াইট ওয়াইনের সঙ্গে মিশিয়ে খেতাম। শেষে সাপটাকে কুচি কুচি করে কেটে সেই মাংস রান্না করে প্রধানমন্ত্রীকে পরিবেশন করা হত।

উগান্ডার সেনাশাসক ইদি আমিনের বিরুদ্ধে নরমাংস খাওয়ার অভিযোগ ওঠে। তাঁর খাদ্যাভাসের বিষয়টি ‘ডিক্টেটরস উইথ স্ট্রেঞ্জ ইটিং হ্যাবিটস’ শীর্ষক একটি লেখায় তুলে ধরেন সাংবাদিক অনিতা সুরিউইচ। এই নিয়ে প্রশ্ন করলে আমিন বলেছিলেন, আমি নরমাংস খুব একটা পছন্দ করি না। কারণ, ওটা নোনতা। স্বাদে আহামরি কিছু নয়।

চীনের চেয়ারম্যান মাও আবার আজীবন দাঁত ব্রাশ করেননি। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জিসুই লি-র লেখা ‘প্রাইভেট লাইফ অফ চেয়ারম্যান’ মাও থেকে জানা যায়, এর জন্য তাঁর মাড়িতে পাথর জমে গিয়েছিল। এই নিয়ে কথা উঠলেই মাও বলতেন, ‘বাঘ-সিংহ কখনোই তাদের দাত পরিষ্কার করে না।’

মিয়ানমারের সেনাশাসক জেনারেল নে উইনের আবার ছিল জুয়ো ও গল্ফের নেশা। খুব দ্রুত রেগে যেতেন তিনি। রাজীব ডোগরার লেখা বই অনুযায়ী, এক বার স্ত্রীর গলায় ছাইদান ছুড়ে মারেন তিনি। আর তাতে উইনের স্ত্রী গুরুতর জখম হয়েছিলেন।

ডোগরা আরও জানিয়েছেন, জ্যোতিষে মারাত্মক বিশ্বাস ছিল উইনের। একবার এক গণক তাকে বলেন, ৯ সংখ্যাটি তার জন্য শুভ। সঙ্গে সঙ্গে ১০০ টাকার নোট প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন জেনারেল নে। বদলে ৯০ টাকার নোট চালু করতে জারি হয় বিজ্ঞপ্তি। ফলস্বরূপ মায়ানমারের আর্থিক অবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।

১৯৮৯ সালে ইরাকের ক্ষমতা দখলের পর সাদ্দাম হুসেন তার ‘বাথ সোশ্যালিস্ট পার্টি’র গণকনভেনশনের আয়োজন করেন। যার ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছিল। বৈঠকে পৌঁছে ৮৬ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে বলে ঘোষণা করেন সাদ্দাম। তাদের মধ্যে ২২ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে ইরানি সেনা।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ