আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম। অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় বিপাকে অলংকার ব্যবসায়ীরা। ক্রেতা সংকটে বিক্রি কমেছে আশঙ্কজনক হারে। অনেক ব্যবসায়ী কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যবসা গোটানোর কথা ভাবছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে টালমাটাল সোনার বাজার।
বর্তমানে দেশের বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৪৯ টাকা। তবে ক্রেতাদের এক ভরি সোনার অলংকার কিনতে গুনতে হচ্ছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৮ টাকা। কারণ সোনার দামের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করে অলংকার বিক্রি করা হয়। সে হিসাবে বর্তমান দামের ভিত্তিতে প্রতি ভরিতে ভ্যাট আসে ৬ হাজার ৮৭২ টাকা এবং ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ২৪৭ টাকা।
হারাচ্ছে ঐতিহ্য
একটা সময় শিশুর জন্ম, বিয়ে, জন্মদিন ও মুসলমানিসহ শুভদিনে সোনার অলংকার উপহার দেওয়া অনেকটাই রীতিতে পরিণত হয়েছিল। মধ্যবিত্তরাও বিশেষ অনুষ্ঠানে আংটি, গলার চেন, হাতের বালা অনেকটা হাসি মুখেই উপহার দিতেন। সোনার অস্বাভাবিক দাম হারিয়ে যেতে বসেছে সেই রীতি। দাম এতটাই বেড়েছে যে ৫-১০ হাজার টাকায়ও ছোটখাটো কোনো অলংকার পাওয়া যায় না।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব কিছু মিলে পুরো পৃথিবীতে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ পরিস্থিতি থাকলে মানুষ সোনার প্রতি ঝোঁকে। সে কারণে এখন সোনার দাম বাড়ছে।- বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া
শুধু মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চবিত্তরাও অনেকে অলংকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একেবারে বাধ্য না হলে এখন কেউ সোনার অলংকার কিনছেন না। ফলে জুয়েলারি ব্যবসায় দেখা দিয়েছে মন্দা।
সংকটে ব্যবসায়ীরা
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আর অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সোনায় বিনিয়োগ বেড়ে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতেও সেটিই হয়েছে। এ কারণে বিশ্ববাজারে সোনার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববাজারে সোনার দাম ওঠা-নামার ক্ষেত্রে ইহুদি তথা ইসরায়েলি ব্যবসায়ীদের একটি বড় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। পুরো বিশ্বে সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন ৩০ জনের মতো। এর মধ্যে বেশিরভাগই ইসরায়েলি। এই ৩০ জনের মধ্যে বাংলাদেশের কেউ নেই। এশিয়া মহাদেশের একজন আছেন।
বিশ্ববাজারে সোনার অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে দেশের বাজারেও দামি এ ধাতুটির দাম বেড়েছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে দামি এই ধাতুটি এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। বিক্রিও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। পাঁচ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে সোনার অলংকার বিক্রি অর্ধেকের নিচে। বিক্রি কমায় ব্যবসায়ীদের লাভও কমেছে। এখন বিক্রি যা হচ্ছে তা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ ও দোকান ভাড়া দিতে অনেক ব্যবসায়ীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হবেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর জুয়েলারি ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। করোনা মহামারির মধ্যে আয় কমে যাওয়ায় অনেকে জমানো সোনা বিক্রি করেন। ফলে বছর দুয়েক আগেও সাধারণ মানুষ সোনা কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন বেশি। এখন সাধারণ মানুষ সোনার অলংকার যেমন কিনছেন না, তেমনি বিক্রিও খুব একটা করছেন না। এতে মনে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে সোনার অলংকার খুব একটা জমা নেই।
সোনার বর্তমান বাজারদর
দেশের বাজারে সোনার দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। সবশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর দেশের বাজারে সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করে সোনা ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনটি।
সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৪৯ টাকা। এছাড়া ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৩১ হাজার ১৯৭ টাকা, ১৮ ক্যারেটের ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৩ এবং সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনা ৯২ হাজার ২৮৬ টাকা। এর সঙ্গে ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করে সোনার অলংকার বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দোকান প্রায় ফাঁকা। আমাদের হিসাবে বিক্রি ৬০-৭০ শতাংশ কমে গেছে। আমরা যেভাবে চলছি, এটাকে চলা বলে না। এটা এক ধরনের স্থবিরতা।- বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান
বিশ্ববাজারে গত সপ্তাহে এক আউন্স সোনার দাম রেকর্ড ২ হাজার ৬৮২ ডলার পর্যন্ত ওঠে। এরপর দাম কিছুটা কমেছে। বর্তমানে (সোমবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত) প্রতি আউন্স সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৫৮ ডলার।
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান এম এ হান্নান আজাদ বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক যে প্রেক্ষাপট, তাতে সোনার দাম কখন কোন দিকে যায় কেউ বলতে পারে না। তবে কমার সম্ভাবনা খুবই কম। সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট আছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের হুংকার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এ পরিস্থিতিতে মানুষ এখন সোনা কেনা নিরাপদ মনে করছে না।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে সোনার দাম নিয়ন্ত্রণ করে ৩০ জনের মতো। এর মধ্যে আমাদের এশিয়ার আছেন মাত্র একজন। বেশির ভাগ ইসরায়েলের। এখন ইসরায়েলে যুদ্ধ চলছে। সোনার দাম বাড়ার এটি একটি বড় কারণ।’
সোনার বাজার যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের নাম কি কখনো প্রকাশ হয়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘না এদের নাম প্রকাশ হয়নি। তবে তাদের বেশির ভাগ ইহুদি এবং ইসরায়েলি।’
দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ায় আপনাদের ব্যবসায় কী ধরনের প্রভাব পড়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায় এত ধস নামছে বলে বোঝানো যাবে না। কোনো দোকানে ক্রেতা নেই। এভাবে চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। সোনার দাম বাড়ার কারণে শুধু বাংলাদেশের সোনার দোকানে বিক্রি কমছে তা নয়, সারা বিশ্বেই কমেছে। দুবাই, সৌদি, বাহরাইন, ইরাক, ইরান, কুয়েত সব জায়গায় সোনার ক্রেতা খুব কম।’
বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব কিছু মিলে পুরো পৃথিবীতে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ পরিস্থিতি থাকলে মানুষ সোনার প্রতি ঝোঁকে। সে কারণে এখন সোনার দাম বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘সোনার দাম বাড়ার কারণে আমরা লাভবান না, বরং লুজার। ক্রেতাদের সাধ্যের বাইরে চলে গেলে তারা কেনা কমিয়ে দেবেন। আগে যিনি তিন ভরি কিনতেন, এখন এক ভরি কেনেন। বিক্রি কমার কারণে আমাদের মুনাফাও কমে যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগের তুলনায় বিক্রি ৫০ শতাংশের ওপরে কমে গেছে। কর্মী কমাতে হচ্ছে, কর্মীদের বেতন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কেউ কেউ কর্মীদের বেতন দিতে সমস্যায় পড়ছেন।’
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ভূরাজনীতি বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়ার একটি কারণ। আর একটি কারণ রিজার্ভ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সোনা মজুত করা হচ্ছে। এখন সোনার দাম বাড়ার বিশেষ কারণ ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমিয়ে দেওয়া। এ কারণে গত সপ্তাহে সোনার দাম বড় অংকে বেড়েছে। সুদের হার কমানোর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সোনার দামের ওপর। এখন টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে।’
দাম বাড়ার কারণে আপনাদের ব্যবসায় কী ধরনের প্রভাব পড়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দোকান প্রায় ফাঁকা। আমাদের হিসাবে বিক্রি ৬০-৭০ শতাংশ কমে গেছে। আমরা যেভাবে চলছি, এটাকে চলা বলে না। এটা এক ধরনের স্থবিরতা।’