মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৪ অপরাহ্ন

পেজার দিয়ে যেভাবে হিজবুল্লাহকে বোকা বানিয়েছে ইসরাইল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • প্রকাশের সময়ঃ বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১৭ প্রদর্শন করেছেন

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাংশের শহরতলীগুলোতে ও হিজবুল্লাহর অন্য শক্তিকেন্দ্রগুলোতে গত সেপ্টেম্বরে কয়েক হাজার পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হন। হিজবুল্লাহ ও লেবাননিজ সরকার উভয়েই এই আক্রমণের দায় ইসরাইলের ওপর চাপিয়েছে।

মূলত হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই অভিনব এই উপায়ে হামলা চালায় ইসরাইল। ১৭ সেপ্টেম্বর ঘটনার সময় হাজার হাজার হিজবুল্লাহ সদস্যের যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন পেজারগুলো একসঙ্গে সঙ্কেত দিয়ে একটি বার্তা আসার ইঙ্গিত দেয় ও বিস্ফোরিত হয়।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কেউ দূর থেকে ডিভাইসগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, যার ফলে আহত হয়েছেন এগুলোর আশপাশে থাকা লোকজনও।

সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ পেজার বিস্ফোরণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, ইসরাইলিদের নজরদারি এড়াতে চলতি বছরের শুরুর দিকে এই পেজারগুলো ব্যবহার শুরু করে হিজবুল্লাহ। কিন্তু নিরাপদ ভেবে ব্যবহার করা সেই পেজারগুলোই তাদের মৃত্যু ফাঁদ হয়।

হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার ইসরাইলি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চলতি বছরের শুরুতে ক্রয়াদেশ অনুযায়ী লেবাননে পৌঁছানো পেজারগুলোতে বিশেষ ধরণের ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়।

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ব্যবহার না করা হিজবুল্লাহর সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেজার বিক্রির জন্য প্রথমে ভুয়া অনলাইন স্টোরের পেজ তৈরি করা হয়। হিজবুল্লাহর বিশ্বাস অর্জন করতে এসব পেজ থেকে নিয়মিত পোস্টও দেওয়া হতো। হিজবুল্লাহকে ফাঁদে ফেলতে এক বছর ধরে এই কার্যক্রম চালায় ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।

তাদের যে এজেন্টরা পেজারগুলো তৈরি করেছিল তারা এমন একটি ব্যাটারি ডিজাইন করেছিল যার মধ্যে একটি ছোট খোপে শক্তিশালী প্লাস্টিক বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখা যায়। এটি এতোটাই অভিনব কায়দায় করা হয়েছিল যেটা খালি চোখে তো নাই, এক্স-রে মেশিনও ধরা যায়নি।

বিস্ফোরণের পরপরই এই পেজার তৈরি করা কোম্পানি হিসেবে তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো নামক একটি কোম্পানির নাম আসে।

তবে তাইওয়ানভিত্তিক গোল্ড অ্যাপোলোর প্রেসিডেন্ট ও প্রতিষ্ঠাতা সু চিং-কুয়াং এ ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, হামলায় ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো তারা তৈরি করেননি।

তবে রয়টার্স ধ্বংস হওয়া পেজারগুলোর ছবি বিশ্লেষণ করে একটি ফরম্যাট এবং স্টিকার মিলিয়ে দেখেছে, যা গোল্ড অ্যাপোলোর তৈরি পেজারের সঙ্গে মিল রয়েছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিজবুল্লাহর বিস্ফোরিত পেজারগুলোর মডেল ছিল এআর-৯২৪।

গোল্ড অ্যাপোলোর চেয়ারম্যান হু চিং-কুয়াং পেজার হামলার একদিন পর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রায় তিন বছর আগে তার প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মচারী তেরেসা উ এবং তার বস টম একটি লাইসেন্স চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

তেরেসা উ এর ব্যাপারে তেমন তথ্য না জানা সত্ত্বেও তিনি গোল্ড অ্যাপোলো ব্র্যান্ডের অধীনে তাদের নিজস্ব পণ্য ডিজাইন করার এবং বাজারজাত করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

চেয়ারম্যান জানান, তিনি যখন এআর-৯২৪ এর মডেল দেখেছিলেন সেটি তার পছন্দ হয়নি।

কিন্তু তারপরও তার কোম্পানির ওয়েবসাইটে পণ্যটির ছবি এবং একটি বিবরণ যুক্ত করেছিলেন।

বিষয়টি হিজবুল্লাহকে দৃশ্যমানতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা উভয়ই দিতে সহায়তা করেছিল। তবে তার ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি এআর-৯২৪ কেনার কোনও ব্যবস্থা ছিল না।

লেবাননের একটি সূত্র ও ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে রয়টার্স জানিয়েছে, ব্যাটারি ডায়াগ্রাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় লিথিয়াম আয়ন সেলের দুই অংশের মাঝে স্যান্ডউইচের মতো প্লাস্টিক বিস্ফোরকের একটি পাতলা বর্গাকার শিট ও অত্যন্ত দাহ্য পদার্থের একটি সলতা ছিল।

পাতলা বর্গাকার শীটটিতে ছিল ছয় গ্রাম সাদা পেন্টারিথ্রিটল টেট্রানাইট্রেট (পিইটিএন) প্লাস্টিক বিস্ফোরক যা দুটি আয়তাকার ব্যাটারি কোষের মধ্যে চেপে রাখা হয়েছিল। ব্যাটারির মধ্যে অবশিষ্ট স্থানে দাহ্য পদার্থের একটি সলতা ছিল, এটি ডেটোনেটর হিসাবে কাজ করেছে।

এই তিন-স্তরের স্যান্ডউইচের মতো অংশটি একটি কালো প্লাস্টিকের কভারের ভেতরে ঢোকানো হয়েছিল এবং মোটামুটি ম্যাচের বাক্সের আকারের একটি ধাতব আবরণে ঢাকা ছিল।

ব্যাটারি সেলগুলোর মধ্যে অবশিষ্ট স্থানটি ছবিতে দেখা যায়নি তবে এটি অত্যন্ত দাহ্য পদার্থের একটি স্ট্রিপ দ্বারা দখল করা হয়েছিল যা ডেটোনেটর হিসাবে কাজ করেছে।

এই তিন স্তরের স্যান্ডউইচটি প্রয়োজনের সময়ে ব্যবহারের জন্য গোপনে একটি কালো প্লাস্টিকের খোপে রেখে দেওয়া হয়েছিল আর সেটি প্রায় একটি ম্যাচ বাক্সের আকারের ধাতব কেসিংয়ের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ফটোগুলো বিশ্লেষণ করে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

ওই লেবাননি সূত্র ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুইজন বোমা বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সন্নিবেশ বিরল কারণ এটিতে ছোট আকারের ডেটোনেটরের যে ধাতব সিলিন্ডার আকৃতি বৈশিষ্ট্য থাকার কথা তা ছিল না।

ধাতব কোনো উপাদান না থাকায় প্লাস্টিক বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটানোর সলতা হিসেবে ব্যবহৃত উপদানটির একটি প্রান্ত থাকলেও তা এক্স-রে মেশিনেও ধরা পড়েনি।

ফেব্রুয়ারিতে হিজবুল্লাহ পেজারগুলোর চালান বুঝে পায়। পেজারের ভেতর বিস্ফোরক আছে কিনা সেটা হিজবুল্লাহ সেটা পরীক্ষা করে দেখেছিল। ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী রয়টার্সকে জানান, তারা সেগুলোকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা স্ক্যানারের মধ্য দিয়ে চালিত করে অ্যালার্ম বেজে ওঠে কিনা তা খতিয়ে দেখেছিলেন তারা। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পায়নি।

ডিভাইসগুলো সম্ভবত এমনভাবে বসানো হয়েছিল যেন ব্যাটারির প্যাকেটের ভেতরেই একটি স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে পারে, আর তা বিস্ফোরকের অতি দাহ্য সলতাকে সক্রিয় করার জন্য যথেষ্ট ছিল আর এভাবেই পিইটিএন শীটটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

বিস্ফোরক ও সেগুলো ঢেকে রাখার উপকরণের জন্য ব্যাটারির আয়তনের এক তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হলেও সেটির মোট ওজন ৩৫ গ্রামই ছিল। কিন্তু এই ওজনের একটি ব্যাটারি থেকে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়ার কথা ব্যাটারিগুলো তার একটি ভগ্নাংশ মাত্র সরবরাহ করছিল বলে দুই ব্যাটারি বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন।

কোনো এক সময় হিজবুল্লাহ খেয়াল করেছিল, ব্যাটারির চার্জ প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুতগতিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এটি বড় ধরনের কোনো নিরাপত্তা উদ্বেগ হিসেবে বিবেচনায় আসেনি। হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেও গোষ্ঠীটি তাদের সদস্যদের মধ্যে পেজার বিতরণ করছিল।

রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এআর-৯২৪ এবং এর ব্যাটারির ছবিগুলো অ্যাপোলেরসিস্টেমএমএসএইচকে ডটকমে আপলোড করা হয়।

ওই ওয়েবসাইটটি দাবি করে, তাদের কাছে গোল্ড অ্যাপোলোর পণ্য বিতরণের লাইসেন্স রয়েছে। ওয়েবসাইটটি অ্যাপোলো সিস্টেমস এইচকে নামে একটি কোম্পানির জন্য হংকংয়ের একটি ঠিকানা দিয়েছিল। কিন্তু ওই ঠিকানায় হংকং করপোরেট রেকর্ডে এই নামের কোনও কোম্পানি নেই।

১৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলী ও হিজবুল্লাহর অন্যান্য ঘাঁটিতে একযোগে হাজার হাজার পেজার বিস্ফোরণ ঘটে।

রয়টার্সের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে অনেকের চোখে আঘাত, আঙুল বিচ্ছিন্ন বা পেটে ছিদ্র ছিল।

আগের দিন পেজার বিস্ফোরণ এবং পরের দিন ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে মোট ৪৯ জন নিহত এবং ৩৪,০০০ এরও বেশি আহত হয়।

পশ্চিমা দুটি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ পেজার ও ওয়াকিটকি হামলায় মূল ভূমিকা পালন করেছে।

ডিভাইসগুলো কোথায় তৈরি করা হয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি রয়টার্স। মোসাদের কর্তৃত্বের অধিকারী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

লেবাননের তথ্য মন্ত্রণালয় এবং হিজবুল্লাহর একজন মুখপাত্র এই নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।

হিজবুল্লাহর পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা ইসরাইল স্বীকার বা অস্বীকার করেনি। তবে হামলার পরদিন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট মোসাদের প্রশংসা করেন।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অভিযানের বিষয়ে তাদের আগে থেকে জানানো হয়নি।

২০২৩ সালের শেষের দিকে দুটি ব্যাটারি স্টোর অনলাইনে এসেছিল। তাদের ক্যাটালগে এলআই-বিটি৭৮৩ ব্যাটারি নামে নতুন ট্যাব খোলা হয়। ব্যাটারির জন্য দুটি অনলাইন ফোরাম চালু করা হয়েছিল। তাতে তথাকথিত ব্যবহারকারীরা ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। তবে এসব ব্যবহারকারীদের পরিচয় জানা যায়নি।

সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এবং দুই পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, ওয়েবসাইট, অনলাইন স্টোর এবং ফোরামের আলোচনা ছিল প্রতারণামূলক। লেবাননে পেজার বোমা বিস্ফোরণের পর থেকে ওয়েবসাইটগুলো উধাও হয়ে গেছে।

পেজারগুলো কিনতে আক্রমণাত্মক বিক্রয় কৌশল ব্যবহার করেছিল ইসরাইলের গোয়েন্দারা। হিজবুল্লাহকে তুষ্ট করতে এসব পেজারের দাম একেবারেই কমিয়ে ধরা হয়েছিল।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ