কঠিন জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি আলোচিত সাবেক এসপি (পুলিশ সুপার) বাবুল আক্তার। স্ত্রী হত্যার দায় মাথায় নিয়ে দুই সন্তানকে নববিবাহিতা স্ত্রীর কাছে রেখে যেতে হয় কারাগারে। কারাগারে যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। অর্থাভাবে তাদের অবস্থাও বেসামাল। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে আক্রান্ত বাবুল আক্তারের অবস্থা বেশ জটিল।
গত বুধবার স্ত্রী মাহমুদা খানম (মিতু) হত্যা মামলায় ৩ বছর ৭ মাস পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। বিকাল ৫টা ৩৮ মিনিটের দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে একটি সাদা প্রাইভেটকারে কারাফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন বাবুল আক্তার। কারামুক্ত হওয়ার পর বাবুল আক্তারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত বাবুল আক্তারের স্ত্রী নুসরাত জাহান মুক্তা।
কারাফটকে বাবুল আক্তারের স্ত্রী নুসরাত জাহান মুক্তা তার শঙ্কার কথা বলেছেন সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে। তিনি বলেছেন, তার (বাবুল আক্তারের) নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এজন্য তাকে কড়া নিরাপত্তায় জেল থেকে বের করা হয়েছে। তবে জেল থেকে বের হয়ে বাবুল আক্তার উপস্থিত সাংবাদিকদের কিছু বলেননি।
বাবুল আক্তারের কারামুক্তির বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল হোসেন। তিনি যুগান্তরকে জানান, সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের জামিনের কাগজপত্র কারাগারে আসার পর যাচাই-বাছাই করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের অক্টোবরে বাবুল আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় মুক্তার। এর ৭ মাস পরই কারাবন্দি হন বাবুল। এরপর থেকে কারাগার এবং আদালতের বারান্দায় ছোটাছুটি করেন তিনি। এছাড়া বাবুলের দুই নাবালক সন্তানের তিনিই এখন মা। তার কাছেই বেড়ে উঠছে মিতুর বাচ্চারা। গর্ভধারিণী না হলেও তিনি মাতৃস্নেহে আগলে রেখে পরম মমতায় তাদের গড়ে তুলছেন।
মুক্তার বাবার বাড়ি চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে। মাস্টার্স পাশের পর তিনি চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এ সময় এক পরিচিত আত্মীয়ের মাধ্যমে বাবুলের সঙ্গে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। সবকিছু জেনেই তিনি রাজি হন। বিয়ের পর স্বামীর মুখেই তিনি মিতু হত্যাকাণ্ডের আরও বিশদ বিবরণ শুনেছেন। বাবুলের চাকরি, পরিবর্তিত নানা পরিস্থিতিসহ অন্যান্য বিষয়েও নানা কথা হয়েছে।
মাহমুদা খানম মিতুকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার দুই সন্তানের বয়স ছিল যথাক্রমে ৫ ও ৭ বছর। দীর্ঘ সময় তারা মায়ের স্নেহ না পেলেও বাবাকে পাশে পেয়েছিল; কিন্তু ২০২১ সালের ১২ মে বাবুলকেও গ্রেফতার করা হয়। এরপর থেকেই তারা মূলত পুরোপুরি পিতামাতার স্নেহ বঞ্চিত। বর্তমানে বাবুলের ছেলে আকতার মাহমুদ মাহের নবম এবং মেয়ে আকতার তাবাসসুম নিখাঁদ পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অসাধারণ মেধাবী মাহের স্কুলে তার শাখায় দ্বিতীয়। আগামী বছর সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা হারানোর শোক তারা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও দুই সন্তানকে ভালো রাখার চেষ্টা করেন মুক্তা। যাতে বাচ্চারা অভাবের কষ্টটা সেভাবে বুঝতে না পারে।
২০১৬ সালের ৫ জুন তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ নিয়ে জঙ্গিদের দিকে সন্দেহের তীর থাকলেও ঘটনার দুই সপ্তাহ পর ২৪ জুন ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ বাবুলকে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পরে পুলিশ প্রশাসন থেকে জানানো হয় স্বেচ্ছায় পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন বাবুল। অবশ্য এখন পর্যন্ত চাকরি ছাড়ার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করে আসছেন বাবুল আক্তার।
একপর্যায়ে ২০২০ সালের ১১ মে অনেকটা নাটকীয়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিয়ে বাবুলকে গ্রেফতার করা হয়। ২০২১ সালের ১২ মে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। একই দিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। ওই দিনই মামলাটিতে বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে পিবিআই। সেই থেকে কারাগারে ছিলেন বাবুল।
গত ২৭ নভেম্বর বাবুল আক্তারকে জামিন দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান ও বিচারপতি আলী রেজার হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। হাইকোর্টের জামিন আদেশ এবং আদালতের বেইল বন্ড পাঠানোর পরও নানা জটিলতার কারণে তিন দিন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।
বৃহস্পতিবার বাবুলের জামিন আদেশে স্থগিত চেয়ে চেম্বার জজ আদালতে আপিল করেন তার শ্বশুর ও মামলার বাদী মোশাররফ হোসেন। শুনানি শেষে মঙ্গলবার আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হলেও আদেশের তারিখ পিছিয়ে যায়। বুধবার শুনানি শেষে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হকের আদালত বাবুল আক্তারের জামিন বহালের আদেশ দেন।